Wednesday, May 14, 2025
Homeছোট গল্পআমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব

আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব

আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব – হুমায়ূন আহমেদ

আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব নামে পুলিশের একজন রিটায়ার্ড এসপি থাকেন। তার স্বভাব হচ্ছে দেখা হওয়া মাত্র অত্যন্ত চিন্তিত মুখে হাই ফিলসফি গোছের একটা প্রশ্ন করা। মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। সেদিন মোড়ের দোকানে সিগারেট কিনছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম মজিদ সাহেব হনহন করে আসছেন। আমি চট করে একটু আড়ালে চলে গেলাম। লাভ হলো না। ভদ্রলোক ঠিক আমার সামনে এসে ব্রেক করলেন এবং অত্যন্ত গম্ভর গলায় বললেন, প্রফেসর সাহেব, মানুষ হাসে কেন একটু বলুন তো?

আমি বিরক্তি চেপে বললাম, হাসি পায় সেইজন্যে হাসে।

হাসি কেন পায় সেইটাই বলুন।

এ তো মহা যন্ত্রণা। ভদ্রলোক যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তাতে মনে হচ্ছে জবাব না বনে তিনি যাবেন না। তাঁর না হয় কাজকর্ম নেই, রিটায়ার্ড মানুষ; কিন্তু আমার তো কাজকর্ম আছে। আমি বললাম, মজিদ সাহেব আমি আপনাকে একটা গল্প বলি। গল্পটা শুনে আপনি হাসবেন। তারপর আপনি নিজেই চেষ্টা করে বের করুন কেন হাসলেন।

এটা মন্দ নয়। বলুন আপনার গল্প।

আমি গল্প শুরু করলাম–এক লোক একটি সিনেমা একত্রিশবার দেখেছে শুনে তার বন্ধু বলল, একত্রিশবার দেখার মতো কী আছে এই সিনেমায়? লোকটি বলল, সিনেমার এক জায়গায় একটি মেয়ে নদীতে গোসল করতে যায়। সে যখন কাপড় খুলতে শুরু করে ঠিক তখন একটা ট্রেন চলে আসে। একত্রিশবার ছবিটা দেখেছি, কারণ আমার ধারণা কোনো না কোনোবার ট্রেনটা লেট করবে।

মজিদ সাহেব আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। অবাক হওয়া গলায় বললেন, ট্রেন লেট হবে কেন? প্রতিবার তো একই ব্যাপার হবে।

আমি বললাম, হাসিটা তো এইখানেই।

একই ব্যাপার প্রতিবারই ঘটেছে, এর মধ্যে হাসির কী?

মজিদ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। মনে হলো আমার ওপর খুব বিরক্ত। আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বললাম, এ জাতীয় অভিজ্ঞতা আপনাদের সবারই নিশ্চয়ই আছে। অনেক আশা নিয়ে একটি রসিকতা করলেন। সেই রসিকতাটা ব্যাঙের মতো চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে গেল।

আমেরিকান এক বইতে একশটি রসিকতা দেওয়া আছে এবং বলা হয়েছে এই রসিকতাগুলির সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই দশমিক তিন দুই ভাগ। আমি এর একটা এক বিয়েবাড়ির আসরে চেষ্টা করে পুরোপুরি বেইজ্জত হয়েছি। একজন শুধু আমার প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে একটু ঠোঁট বাঁকা করেছিলেন। কিন্তু অন্যদের গম্ভীর মুখ দেখে সেই বাকা ঠোঁট সোজা করে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। জনৈকা তরুণী চশমার ফাঁক দিয়ে এমনভাবে আমাকে দেখতে লাগল যেন আমার মাথায় দোষ আছে।

গল্পটা এরকম—

এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছে, প্যারিস শহরটা কেমন?

বন্ধু বলল, ভালো। সেখানে এয়ারপোর্টে নেমে তুই যদি একটা মোটর গাড়ি ভাড়া করিস, তাহলে দেখবি সেই ড্রাইভার তোর সঙ্গে কী ভদ্র ব্যবহার করছে। এমনও হতে পারে সে তোকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবে। রাখবে তার বাড়িতে। নাচ-গান করবে। এবং এই যে তুই তার বাড়িতে থেকে এত আনন্দ ফুর্তি করলি, তার জন্যে উল্টো তোকে একগাদা টাকা দিবে।

বলিস কী! তুই গিয়েছিলি নাকি প্যারিসে?

আমি যাইনি, আমার বউ গিয়েছিল। তার প্র্যাকটিক্যাল এক্সপিরিয়েন্স। সে তো আর বানিয়ে বানিয়ে বলবে না। এরকম মেয়েই সে নয়।

এই গল্পে কেউ হাসল না কেন? আমি ভেবেটেবে বের করলাম–এরকম একটি ভেলা যুবকের এমন বউ থাকতেই পারে না যে একা একা প্যারিসে যাবে। এই কারণেই গল্পটি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।

কী যন্ত্রণা, হাসির গল্পের আবার বিশ্বাসযোগ্যতা কী! আমাদের মুশকিল হচ্ছে সিরিয়াস গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। হাসির গল্প হলেই গম্ভীর হয়ে ভাবতে বসি, গল্পটি কি বিশ্বাসযোগ্য? ভেন্দা ধরনের ছেলেটার বউ প্যারিসে কেন গেল?

রসিকতা যারা করেন তারা বেইজত হওয়ার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই করেন। নো রিক নো গেইন-এর ব্যাপার এবং দুএকটা যন লেগে যায় তাদের উৎসাহের সীমা থাকে না। রসিকতা করাটাকে তখন তারা পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। আগাড়ে বাগাড়ে রসিকতা করে আশেপাশের মানুষদের বিরক্তির চরম সীমায় পেীছে দেন। আমি একবার শামণী থেকে নিস্তান যাওয়ার পথে এরকম একজনের দেখা পেয়েছিলাম। বাসে অব ভিড়। প্রচণ্ড গরম। ঘামের কটু গন্ধ। এর মধ্যে একজন তার পরিচিত একজনকে পেয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই মোজাম্মেল, একটা চুটকি শোন। একবার এক বিয়েবাড়িতে বরযাত্রী আসতে দেরি করছে, তখন বরের ফুফাতো বোন…

মোজাম্মেল যার নাম সে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাতে লাভ হলো না। ভদ্রলোক দীর্ঘ গল্প শেষ করে দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। টাক-মাথায় এক লোক বিরক্ত হয়ে বললেন, চুপ করেন তো ভাই।

কেন চুপ করব? আপনার কী অসুবিধা করলাম?

কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করছে, এটা অসুবিধা না?

ভ্রলোক চুপ করে গেলেন। সায়েন্স ল্যাবরেটরি পর্যন্ত এসেই আবার তার গলা খুসখুস সুতে লাগল। তিনি মোজাম্মেলকে তিন নম্বর রসিকতাটি বললেন। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার, এই রসিকতাটি হিট করল। বাসসুদ্ধ লোক হু-হু করে হেসে উঠল। এমনকি সেই টাক মাথার লোক ঠা ঠা জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে হাসতে লাগলেন।

অবশ্যি এ সংসারে কিছু ভাগ্যবান লোক আছেন, তাদের সব রসিকতাই পাবলিকে খায়। এটা বিরাট একটা যোগ্যতা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, যারা এই যোগ্যতা অর্জন করেন অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যেতে দেখা যায়। জীবনের প্রতি সব রকম আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। চল্লিশ না হতেই তাদের দেখা যায় পঞ্চাশের মতো। কারণ খুব সহজ, এই জাতীয় জন্মরসিকদের সব কথাকেই আমরা সবাই রসিকতা হিসেবে নেই। যা একসময় জন্মরসিকের ওপর মানসিক চাপ ফেলতে শুরু করে।

উদাহরণ দেই, আমার এক বন্ধু আব্দুস সোবাহান একজন জন্মরসিক। স্কুলজীবন। থেকে সে আমাদের হাসাচ্ছে। কলেজ জীবনেও একই অবস্থা। সংসারে ঢুকে সে নানান। সমস্যায় পড়ল। অল্প বেতন। অনেকগুলি ছেলেপুলে, অভাব-অনটন। একেকবার সে দুঃখের গল্প করে, আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। একবার বিকেলবেলা মুখ শুকনো করে। বলল, ঘরে আজ রান্না হয় নাই ভাই। একটা পয়সা ছিল না।

তার কথা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী মজার ব্যাপার, ঘরে পয়সা নেই।

শেষ করার আগে এই প্রসঙ্গে একটা দামি উপদেশ দিতে চাচ্ছি। অল্পবয়সা মেয়েদের সঙ্গে কখনো কোনো রসিকতা করবেন না। যদি এদের কোনো একটি রসিকতা পছন্দ হয়ে যায় তাহলে আপনার অবস্থা কাহিল। ওই গল্পটা আরেকবার বলেন না। ওই গটা আরেকবার বলেন না।

শিরীন নামের এক মেয়েকে কোন এক কুক্ষণে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প বলেছিলাম। তারপর থেকে যেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে এবং বলে-ওই গল্পটা আরেকবার বলেন, প্লিজ।

আমাকে বলতে হয়। তিন বছরের মধ্যে আমি হাজার খানিকবার এই গল্প বললাম। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে কাছে পেলেই কাঁচা খেয়ে ফেলি এমন অবস্থা। সেই সময়কার কথা, নিতান্ত উপায়ান্তর না দেখেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রাডারের প্রেসার কমাচ্ছি মনে মনে প্রার্থনা করছি যেন পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা না হয়। ঠিক তখন আমার পেছনে একটা রিকশা থামল। আমার বুক ধক করে উঠল। শিরীনের আদুরে গলা, হুমায়ূন ভাই, এখানে কী করছেন?

আমি মনে মনে বললাম, হারামজাদি দেখছিস না কী করছি? দ্রুত জিপার লাগাতে গিয়ে আরেকটা অ্যাকসিডেন্ট হলো। জিপার দেওয়া প্যান্ট যারা পরেন তাদের জীবনে এ জাতীয় দুর্ঘটনা একাধিকবার ঘটে। তবু ফ্যাকাসে হাসি হেসে বললাম, তারপর কী খবর, ভালো তো?

শিরীন বলল, এ হচ্ছে আমার বান্ধবী লোপা, আপনি একে ওই গল্পটা বলেন তো। প্লিজ। না না, বলতেই হবে। আমি কোনো কথা শুনব না।

সেই থেকেই আমি কারও সঙ্গে রসিকতা করতে পারি না। কারও রসিকতা শুনে হাসতেও পারি না। রিটায়ার্ড এসপি মজিদ সাহেবের মতো নিজেকে প্রশ্ন করি, মানুষ হাসে কেন?

পুনশ্চ : উন্মাদ-এর পাঠকদের জন্যে একটি রসিকতা। এই রসিকতা অনেকটা আইকিউ টেস্টের মতো। এটা শুনে যদি কেউ যদি হাসে তাহলে বুঝতে হবে তার বুদ্ধি কম। যে যত শব্দ করে হাসবে সে তত বোকা। যদি না হাসে তাহলে বুদ্ধিমান। যদি বিরক্ত হয় তাহলে আঁতেল।

এক লোক কানে কম শোনে।

সে তার বেগুনক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পথচারী এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলেপুলে কী?

লোকটি বলল, বছরে দুই একটা হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খাই।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments