বাঘ ও বকের গল্প
জঙ্গলে একদিন ঘটে গেল এক অদ্ভুত কাণ্ড। এক বাঘের গলায় হঠাৎ করে একটা হাড় আটকে গেল। বাঘের জিভে পানি এসে গেলেও, হাড়টা তাকে এমন যন্ত্রণা দিচ্ছিল যে তার মুখে খাবার তোলা তো দূরের কথা, ঠিকমতো নিশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। গলা ফুলে উঠেছে, চোখ লাল, জিভ ঝুলে পড়েছে। বাঘের অবস্থা তখন যেন মৃতপ্রায়।
বাঘ বনের রাজা বটে, তবে হাড় গলায় আটকে গেলে তারও রাজার হাল থাকে না। ব্যথায় কাতর হয়ে সে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে লাগল। যার সঙ্গেই দেখা হয়, তার কাছেই মিনতি করে বলে, “ভাই, যদি তুমি আমার গলা থেকে এই অভিশপ্ত হাড়টা বের করে দাও, আমি তোমায় পুরস্কার দেবো। তুমি যা চাও তাই দেবো। এমনকি আমি তোমার আজীবনের গোলাম হয়ে থাকবো।”
বাঘের মুখ থেকে এমন কথা শুনে প্রথমে সবাই অবাক। তবে অবাক হওয়ার চেয়ে সন্দেহই যেন বেশী। কারণ কে না জানে, বাঘকে বিশ্বাস করা মানেই নিজের জীবন বিপন্ন করা। হোক না সে যন্ত্রণায় অস্থির, বাঘ তো বাঘই!
একটি শেয়াল এগিয়ে এসে বলল, “তুমি চাও আমি তোমার গলায় হাত দিই, হাড়টা বের করি, আর তুমি সেই সুযোগে আমাকেই খেয়ে ফেলো? খুব সুন্দর পরিকল্পনা, বাহ!”
বাঘ ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বলল, “আরে না রে ভাই, আমি তোমার উপকার করবো। যন্ত্রণায় মরছি আমি, তোমরা সবাই আমাকে ভুল বুঝছো।”
তবুও কেউ রাজি হলো না। বনের প্রতিটি জন্তু বাঘের মিষ্টি কথায় কান দিলেও, নিজের জীবন দিয়ে পরীক্ষা করার মতো বোকা কেউ ছিল না।
এভাবে একে একে সবাইকে ফিরিয়ে দিয়ে, অবশেষে বাঘের সামনে এসে দাঁড়াল এক বক। লম্বা গলা, ধারালো ঠোঁট, মাথায় চঞ্চলতা– বকটা একটু আলাদা স্বভাবের। পুরস্কারের লোভে সে বলল, “ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করি। তবে সাবধান, কথা কিন্তু রাখতেই হবে।”
বাঘ মাথা নাড়ল, চুপচাপ মুখ খুলে দাঁড়িয়ে রইল। বক তার লম্বা ঠোঁট বাঘের ভয়ঙ্কর গহ্বরে ঢুকিয়ে দিয়ে, অনেক যত্ন করে, সতর্কভাবে সেই হাড়টি বের করে আনল। হাড় বের হতে না হতেই বাঘ হাঁ করে বড় এক হাই তুলল। যেন প্রাণ ফিরে পেল। কয়েক মুহূর্তেই সে সুস্থ হয়ে উঠল, যেন কিছুই হয়নি।
বক দাঁড়িয়ে, মুখে একটু হাসি নিয়ে বলল, “তো, এখন আমার পুরস্কার?”
বাঘ তখন চোখ লাল করে, দাঁত কড়মড় করে বলল, “পুরস্কার? তুই বাঘের মুখে ঠোঁট ঢুকিয়েছিলি, তবুও তোকে তখন খাইনি, সেটাই তো তোদের জন্য পুরস্কার। বোকা কোথাকার! এখন আবার দাঁড়িয়ে পুরস্কার চাইছিস! যদি প্রাণ নিয়ে বাঁচতে চাস, তাহলে এক্ষুনি আমার সামনে থেকে সরে যা। না হলে এই মুহূর্তে তোকে কচমচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব।”
বকের মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতটা অন্যায় আর অকৃতজ্ঞতা সে কখনো কল্পনাও করেনি। বাঘের হুমকি শুনে হতবুদ্ধি হয়ে সে দ্রুত উড়ে পালাল।
পেছনে পড়ে রইল শুধুই প্রশ্ন: উপকারের মূল্য কি এই?