Sunday, June 29, 2025
Homeমজার গল্পভূতের কাণ্ডজ্ঞান – তারাপদ রায়

ভূতের কাণ্ডজ্ঞান – তারাপদ রায়

ভূতের কাণ্ডজ্ঞান – তারাপদ রায়

ভাগ্য এবং জীবিকাসূত্রে আজ বছরখানেক হল আমি একটি রহস্যময় বাড়িতে বসবাস করছি, বাড়ি বলে বলা উচিত প্রাসাদোসম অট্টালিকা। গভীর নিশীথে এ-বাড়ির আনাচে-কানাচে নূপুরের নিক্কণ, রূপসীর ক্রন্দনধ্বনি, বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। কখনও বালুবেলায় উদ্দাম ঢেউয়ের মতো দূরে কোথাও থেকে উন্মাদের অট্টহাসি এ-বাড়ির দেয়ালে আছড়িয়ে পড়ে।

আমার একতলায় থাকেন ডাক্তার বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি প্রকৃতই ডাক্তার, চিকিৎসা বিদ্যার ডাক্তার, অ্যানেসথেসিয়া অর্থাৎ অবেদনের অধ্যাপক, রীতিমতো বিজ্ঞানবাদী। তিনি হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা আমাকে বললেন, ‘মশায়, একটা খোঁজ নেবেন তো এ-বাড়িতে কখনও কেউ খুন-টুন হয়েছিল কি না, কেউ আত্মহত্যা করেছিল কি না?’

একটু আগে লোডশেডিং হয়েছিল, তাই দু’জনেই বাড়ির পাশের ফাঁকা মাঠটায় বসেছিলাম। ডাক্তারবাবুর প্রশ্নে জরাজীর্ণ, অন্ধকার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন ছমছম করে উঠল। এ রকম দু’-একটা বাড়ি শহরতলির বা পুরনো গ্রামগঞ্জের একান্তে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দেখা যায়, কিন্তু একেবারে মহানগরের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে, কী রকম যেন অস্বাভাবিক, কী রকম যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়। অনেক সময় কাঠের সিঁড়িতে মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পাই, আলগা কথাবার্তা। দরজা খুললে কিন্তু কাউকে নামতে অথবা উঠতে দেখি না। ভয় হয়, গরিব মানুষ, বড় বাড়িতে থাকার লোভে শেষে সবংশে নিধন না হই।

প্রথম প্রথম ভূতের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য লড়াই করেছিলাম। বাথরুমের একটা সাবানে ভূত প্রতিদিন রাতে, সে যে এসেছিল সেটা জানাত, নখের আঁচড় রেখে যেত। একদিন ধরে ফেললাম ভুত মহোদয়কে, ছুঁচোর ছদ্মবেশে এসে দৈনিক রাতে সাবানটাকে দাত দিয়ে কাটে। বাথরুমের দরজা খুলে কুকুরটাকে দু’দিন বাথরুমের সামনে রাখলুম। ভুত এল না। ছাদের ওপরের ট্যাঙ্ক চুঁইয়ে জল দোতলার জানলায় একটা ভাঙা কাচের শার্সির ওপরে পড়ে, পাশের ঘর থেকে অন্ধকার রাতে মনে হয় নূপুর বাজছে, সেটাও আবিষ্কার করলাম।

এই রকম দু-চারটে ধরে ফেললাম। কিন্তু ভয় এখনও কাটেনি। আমার সাহস এখন খুব কম। ভূতের বিশ্বাস করি না কিন্তু ভয় পাই। ভূতের ব্যাপারে সাহসের ব্যাপারে আমার বন্ধু চৌধুরী সাহেবের গল্পটা বলি।

চৌধুরী সাহেব গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদে, উঠেছিলেন মুর্শিদাবাদের সদর শহর বহরমপুরে সারকিট হাউসে। এটা সেই পুরনো সারকিট হাউস। এর সংলগ্ন পেছনের জমিতে আজকাল নতুন সারকিট হাউস হয়েছে, সেটা আলাদা। কিন্তু এই বহু পুরনো সারকিট হাউসটি, এর আশেপাশের সরকারি আবাসগুলি, এমনকী জেলাশাসকের বাড়িটি পর্যন্ত ভৌতিক সম্পদের জন্য বিখ্যাত।

এখানকার প্রধান বিশেষত্ব হল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম এবং রাইটার্স বিলডিংস আর দার্জিলিং-এ একটা পোড়া বাড়ি বাদ দিলে সারা পশ্চিমবঙ্গে শুধু এখানেই এখনও সাহেব ভূত আছে।

এইখানে ভূতেদের বিষয়ে দু’-একটা কথা লিখে রাখি। সম্প্রতি প্রাণের দায়ে বিষয়টি আমি অধ্যয়ন করেছি। নানা রকম, নানা জাতের ভূত আছে। সাধারণ হিন্দু ভূতের-পেত্নী ছাড়াও, অপঘাতে মৃত ব্রাহ্মণ ভূত রয়েছে। তারা হল ভূত সমাজের শিরোমণি, তাদের বলা হয় ব্রহ্মদৈত্য, হিন্দিতে বলে বরমপিশাচ। মুসলমান ভূত হল মামদো, শব্দটা মহামেডানের অপভ্রংশ। সাহেব ভূত হল শুক, মেমসাহেব পেত্নী হল পিক্সি।

আজকাল ভূতের-পেত্নী এমনিই খুব কমে গেছে। শুক বা পিক্সি তো দেখাই যায় না। যা হোক, এই রকম একটি পুক এখনও বহরমপুরের পুরনো সারকিট হাউসে আছে। কেউ বলে ইনি স্বয়ং ক্লাইভ সাহেব, কেউ বলে ওয়ারেন হেস্টিংস। আবার কারও ধারণা, ইনি ফাদার জিন নামে এক প্রাচীন পাদরি, অন্যদের ধারণা এক নীলকর সাহেব, যে দেড়শো বছর আগে এ-বাড়িতে খুন হয়েছিল।

সে যা হোক, সাহেব ভূতরা খুব খারাপ হয় না। তারা কোটপ্যান্ট পরে নিরিবিলিতে থাকতেই ভালবাসে, তাদের দেখলে, শুধু ‘হ্যালো, মিস্টার স্পুক’ বললেই তারা খুশি।

বহরমপুরের পুরনো সারকিট হাউসের একটি ঘরে চৌধুরী সাহেবের ঘুম ভাঙল এক রাতে। আলোর সুইচটা বিছানা থেকে অনেক দূরে, চৌধুরী সাহেব বাথরুমে যাওয়ার জন্যে উঠলেন। ঘরটা ভাল চেনা নয়, আজকেই এসেছেন। ঘরের সঙ্গেই বাথরুম রয়েছে কিন্তু তিনি অন্ধকারের মধ্যে বাথরুমের দরজা ভুল করে ভিতরে হলঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। উপরে স্কাইলাইট থেকে ক্ষীণ চাঁদের আলোয় চৌধুরী সাহেব দেখতে পেলেন, হলঘরে সোফার মধ্যে অন্ধকারে বিলিতি পোশাক পরা কে একজন বসে রয়েছে। চৌধুরী সাহেবের বুঝতে এক মুহূর্ত দেরি হল না, সঙ্গে সঙ্গে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘হ্যালো, মিস্টার স্পুক।’

ছায়ামূর্তিটা ঘাড় দোলাল, চৌধুরী সাহেব বিনীতভাবে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিস্টার স্পুক, আপনি তো পুরনো বাসিন্দা, দু’-একশো বছর এ-বাড়িতে হয়ে গেল। আমাকে একটু দয়া করে বলে দেবেন বাথরুমটা কোন দিকে!’ মিস্টার স্পুক কিন্তু সহজ বাংলায় বললেন, ‘ভেতরে ঢুকে বাঁদিকে।’

চৌধুরী সাহেবের এই বৃত্তান্ত শুনে আমি বলেছিলাম, ‘বস্তুটি সাহেব ভূত না হয়ে জান্ত বাঙালিও তো হতে পারে? হয়তো ঘর খালি পায়নি, তাই হলঘরে রাত কাটাচ্ছিল।’ চৌধুরী সাহেব বলেছিলেন, ‘পাগল নাকি মশায়! একে বহরমপুর সারকিট হাউস, অন্ধকার মধ্য রাত, কোটপ্যান্ট পরে চুপচাপ বসে আছে, সাহেব ভূত না হয়ে যায়?’

এতটা লিখে, এখন এই রাত বারোটায় কেমন যেন মনে হচ্ছে, ভূতের ব্যাপারটা কাণ্ডজ্ঞানে টেনে আনা সংগত হয়নি। আমার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া, বাঙালি পাঠক ভূতের বিষয়ে মজার কথা অনেকদিন ধরেই শুনছেন।

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় ভূত চিপে তেল বের করেছিলেন। পরশুরামের ‘ভূশণ্ডির মাঠে’ কিংবা ‘মহেশের মহাযাত্রা’ অন্তত দশবার করে পড়েনি এমন পাঠক আছে কি? আর সেই জটাধর বক্সী, দিল্লির গোল মার্কেটের ক্যালকাটা টি ক্যাবিনে সেই বহিরাগত, সে কি জোচ্চোর না ভূত?

শিবরাম চক্রবর্তীরও কোনও তুলনা নেই। দার্জিলিং-এ জলাপাহাড়ে বড় ভতের উপদ্রব আগের বারে মনুষ্যবেশী ভূত যে ব্যক্তিটিকে খাদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরেছিল, সে সেই জায়গাতেই এবারেও বসে আছে, তবে এখন সে নিজেও ভূত। কিন্তু পুরনো ভূত তা বুঝতে পারেনি, তাকে এবারও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে গিয়ে নতুন ভূতের অশরীরী দেহের ভেতর দিয়ে গলে গিয়ে পুরনো ভূত নিজেই খাদে পড়ে গেল।

আর শেষতম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সরল, অমায়িক, মিশুকে ভূতেরা শীর্ষেন্দুর পোষমানা। শীর্ষেন্দু সামান্য স্মরণ করলেই তারা তাদের সূক্ষ্মদেহ শীর্ষেন্দুর কলমের নিবের ফাঁকে গলিয়ে দেয়।

সুতরাং ভূতের কাণ্ডজ্ঞানে প্রয়োজন নেই। তবে শেষ করার আগে ভূত সম্পর্কে আমার নিজের একটা সাহসের গল্প বলি।

গল্পটা পনেরো বছর আগেকার। তখন আমি এত কাপুরুষ ছিলাম না। তখন আমাদের পুরনো পণ্ডিতিয়া পাড়ার সন্ধ্যা সঙঘ ক্লাবের গৃহনির্মাণ তহবিলে টাকা তোলা হচ্ছে। যদিও এ কাজে আমি খুব পটু নই, আমার উপরে পড়েছিল একশো টাকা চাঁদা আদায়ের দায়িত্ব। টাকা-পয়সা কিছু আদায় করতে পারিনি কিন্তু চাঁদার বইটা আমি সব সময় পকেটে রাখতাম।

ওই সময় একটা কাজে একটু পাটনা গিয়েছিলাম। উঠেছিলাম একটা ধর্মশালায়। এক বন্ধুর বোনের পাটনায় বিয়ে হয়েছে, সন্ধ্যাবেলায় তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, ধর্মশালার নাম শুনে সে বলল, ‘ও তারাপদদা, ওখানে থাকবেন না, ওখানে ভীষণ ভুতের উৎপাত।’

সত্যি রাতে ভূত এল। বিছানায় ঘুমিয়ে আছি ধর্মশালায়, হঠাৎ কীসের শব্দে ঘুম ভাঙতে দেখি মশারির বাইরে ছায়া-ছায়া কী যেন হাত বাড়িয়ে আমার বালিশের নীচে কী খুঁজছে। বাধ্য হয়ে জানতে ইচ্ছে হল, ‘ভূত নাকি?’ বালিশের নীচে হাতটি শক্ত হল, মুখ দিয়ে চন্দ্রবিন্দু লাঞ্ছিত দুটি শব্দ বেরল, ‘হাঁ ভূত।’ বালিশের নীচ থেকে ম্যানিব্যাগ, টর্চ ও হাতঘড়িটা বার করে নিলাম। এক পাশে ছিল সন্ধ্যা সঙ্ঘের চাঁদার খাতাটা, সেটা ভূতের হাতে তুলে দিয়ে বললাম, ‘ভূতজি, এ-ঘরে আরও অনেক লোক শুয়ে আছে। আপনি নিশ্চয় তাদের কাছেও যাবেন। দেখবেন তো আমাদের ক্লাবের গৃহনির্মাণ ফান্ডে কিছু আদায় করা যায় কি না। বড় ফ্যাসাদে আছি, একশোটা টাকা তুলতেই হবে।’ তারপর মানিব্যাগ, ঘড়ি ইত্যাদি বালিশের খোলের মধ্যে ভরে সেটাকে শক্ত করে জাপটে আবার ঘুম দিলাম।

ভূতজি আমার বাংলা বুঝতে পেরেছিলেন কি না জানি না, কিন্তু তিনি যে এসেছিলেন তার প্রমাণ, পরদিন ভোরে ধর্মশালার উঠোনে দেখলাম চাঁদার খাতাটি তিনি রেগে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে রেখেছেন।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments