Friday, August 15, 2025
Homeকিশোর গল্পবৃষ্টি আর কেকের গল্প

বৃষ্টি আর কেকের গল্প

বৃষ্টি আর কেকের গল্প – অনন্যা দাশ

সেদিন স্কুল থেকে ফিরে বৃষ্টি মা-কে বলল, “মা জানো আমাদের টিচার আজ বলেছেন কালকে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে আমাদের ক্লাসে পটলাক লাঞ্চ হবে!”
মা ভাইয়ের জন্যে দুধ গরম করছিলেন, বৃষ্টির কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়ে বললেন, “ও!”

বৃষ্টি তাতে শান্ত হল না মোটেই, মা-কে জিজ্ঞেস করতে লাগল, “পটলাক মানে কী তুমি জানো?”

ওরা মার্কিন মুলুকে আসার পর নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে বৃষ্টি প্রায়ই নানা রকম নতুন নতুন কথা শুনে আসে আর মা-কে সেই সব ধাঁধার উত্তর দিতে হয়।

এই ধাঁধার উত্তরে মা বললেন, “হুঁ! সবাই কিছু কিছু খাবার নিয়ে যাবে তারপর একসঙ্গে মিলে খাওয়া হবে, তাই তো?”

বৃষ্টি বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল, “হ্যাঁ সেটাই তো! তুমি কী করে জানলে?”

মা আর উত্তর দিলেন না, ভাইকে বোতলে করে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত। বৃষ্টির ভাইটার পাঁচ মাস বয়স। এমনিতে খুব ভালো, হাসে খেলে কিন্তু খিদে পেলে আর দেখতে হয় না, চেঁচিয়ে একেবারে পাড়া মাথায় করে।

বৃষ্টি আর থাকতে না পেরে বলল, “কে কী নিয়ে যাবে সেটা টিচার বলে দিয়েছেন। আমাকে একটা কেক নিয়ে যেতে বলেছেন। তুমি কিনে দিতে পারবে?”

মা একটু ভেবে বললেন, “না, বাইরে খুব ঠান্ডা আর কেকের দোকান অনেক দূরে তাই কিনে দিতে পারব না। কিন্তু বাড়িতে সব কিছুই আছে, বাড়িতেই কেক বানিয়ে দিতে পারি, তাহলে চলবে? তোমার টিচারেরও বাপু বলিহারি যাই, একটু সময় দিতে পারতেন তো! কালকেই পটলাক করতে হল? একেই বাবুকে নিয়ে হিমসিম অবস্থা!”

মার কথা শুনে বৃষ্টি একটু দমেই গেল। সে মনে করেছিল দোকান থেকে কেনা একটা দারুণ সাজানো কেক নিয়ে যাবে স্কুলে কিন্তু এটাও ঠিক যে বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। বাবা থাকলে গাড়িতে উঠে ঝাঁ করে দোকান থেকে একটা বড়ো কেক কিনে নিয়ে আসতে পারতেন কিন্তু বাবা তো টুরে গেছেন, শনিবার ফিরবেন। পটলাকটাতো কালকেই, মানে শুক্রবার। মা তো গাড়ি চালাতে পারেন না আর এই ঠান্ডায় হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয়। আগত্যা সে মা-কে বলল, “ঠিক আছে তুমিই বানিয়ে দিও কিন্তু একটু ভালো করে সাজিয়েটাজিয়ে দিও যাতে দেখতে খুব ভালো লাগে!”

মা বললেন, “আচ্ছা দেখি কী করা যায়।”

এর পর বৃষ্টি সারা বিকেল অপেক্ষা করে রইল মা কখন কেক বানাবেন আর ও দেখবে। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল কিন্তু কেক আর তৈরি হল না। মা রান্নাবান্না আর ভাইয়ের দেখাশোনাতেই ব্যস্ত হয়ে রইলেন। পরদিন স্কুল থাকলে বৃষ্টি রাত দশটা নাগাদ শুতে যায়, ভোরে উঠে তাকে বাস ধরতে হয় বলে। সে শুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কেক দেখতে পেল না তাই বেশ চিন্তিতভাবেই মাকে বলল, “মা কেক তো এখনও তৈরি হল না তাহলে আমি কাল স্কুলে কী নিয়ে যাব?”

মা ওর কথা শুনে বললেন, “মনে আছে বাবা, মনে আছে! এই তো এতক্ষণে বাবু ঘুমোলো এবার আমি অন্য কাজে নামব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো নাহলে কাল ভোরে উঠে বাস ধরতে পারবে না।”

বৃষ্টি আর কী করবে সে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই সে ছুটে গেল রান্নাঘরে। সেখানে কিছু নেই তবে খাবার টেবিলে একটা কৌটোতে ভরে রেখেছেন মা কেকটাকে। যাক বাবা! শুধু কৌটো দেখেই শান্ত হল না বৃষ্টি, ভিতরে কী রয়েছে সেটাও তো দেখতে হবে! সে কৌটোটাকে খুলে ফেলল। ভিতরে রয়েছে একটা গোল খয়েরি রঙের কেক। একদম সাধারণ দেখতে। মা-কে তো সে কেকটা সাজিয়ে দিতে বলেছিল কিন্তু মা সে সব কিছুই করেননি। বৃষ্টি কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “এই বিশ্রী দেখতে কেকটাকে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতে হবে? তোমাকে ওপরটা একটু সাজিয়ে দিতে বলেছিলাম তাও করে দাওনি!”

মা শান্ত ভাবে বললেন, “কী দিয়ে সাজাবো? ওই রংবেরঙের জেমসের মতন চকোলেটগুলো তো তুমি সব খেয়ে ফেলেছো!”

বৃষ্টি এবার একটু থমকালো, সত্যিই তো! সব ছোট ছোট চকোলেটগুলো তো সেই খেয়ে ফেলেছে। এদিকে কেক না নিয়েও তো স্কুলে যাওয়া যাবে না তাই ওই সাধারণ খয়েরি কেকটাকে নিয়েই বাসে উঠল বৃষ্টি। মনটা ভারি খারাপ। ওই বিশ্রী দেখতে কেকটাকে কী করে টিচারকে দেবে সে? লজ্জায় মাথা কাটা যাবে একেবারে।

তারপর ক্লাসে গিয়ে মনটা আরো দ্বিগুণ খারাপ হয়ে গেল। আরিয়ানা বলে যে অন্য মেয়েটাকে টিচার কেক আনতে বলেছিলেন তাদের নাকি নিজেদের বেকারি আছে। সে একখানা দারুণ সুন্দর দেখতে কেক নিয়ে এসেছে। কেকটা হলুদ, সাদা, গোলাপি থোকা থোকা ক্রিমের ফুল দিয়ে সাজানো। দারুণ দেখতে। দোকানের কেক যেমন হয় তেমন আর কী, একেবারে নিখুঁত। ওই কেক ফেলে বৃষ্টির কেক কে খাবে? কেকের কৌটোটার ওপর একটা কাগজে বৃষ্টির নাম লিখে সেলো টেপ দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন মা। বৃষ্টি সবার অলক্ষ্যে সেই কাগজটাকে তুলে ছিঁড়ে ফেলে দিল যাতে কেউ বুঝতে না পারে কে ওই সাধারণ দেখতে কেকটা এনেছে।

ক্লাসের পিছনের দিকে একটা টেবিলে সব খাবারগুলো জড়ো করে রাখা হচ্ছিল। নামহীন কেকের কৌটোটা অন্য সব খাবারের সঙ্গে রেখে দিল বৃষ্টি। যাক শান্তি! কেউ জানতে পারবে না, আর না জানলেই তো হল। মার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল বৃষ্টির। কেন ওই রকম সাদামাটা একটা কেক বানিয়ে দিলেন মা? এর থেকে কিছু না বানিয়ে দিলেই ভালো হত মনে হয়।

টিচার বললেন দুপুর বারোটা পর্যন্ত পড়াশোনা, তারপর খাওয়াদাওয়া করে ছুটি। ক্রিসমাসের আগের শুক্রবার তাই সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ার কথা। ঠিক বারোটা নাগাদ সবাই খেতে বসল। খুব মজা হচ্ছিল। কত রকমের খাবার। কেক তো একদম শেষে খাওয়ার কথা তাই বৃষ্টি ও নিয়ে আর চিন্তা না করে ব্যাপারটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল। আরিয়ানার কেক তো রয়েছে, সবাই ওটাই খাবে না হয়। হঠাৎ সস দিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে গিয়ে এক খাবলা সস বৃষ্টির জামায় পড়ে গেল।

টিচার তাই দেখে বললেন, “ব্রি যাও ওটা ধুয়ে এসো নাহলে জামাতে দাগ হয়ে যাবে। অত সুন্দর জামাটা নষ্ট হয়ে যাবে!” বৃষ্টিকে এখানে ক্লাসে সবাই ‘ব্রি’ বলেই ডাকে, ওটাই নাকি সহজ!

এখানে স্কুলে ইউনিফর্ম নেই। যে যেমন ইচ্ছে জামা পরে আসতে পারে। আজ ক্রিসমাস পার্টি তাই টিচার সবাইকে ভালো জামা পরে আসতে বলেছিলেন, ছবি তোলা হবে বলে। সত্যি এই সুন্দর জামাটা নষ্ট করলে মা ভারি বকবেন বৃষ্টি জানে তাই সে উঠে বাথরুমে গেল সস ধুয়ে ফেলতে। ওদের টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট মিসেস মিলারও গেলেন ওর সঙ্গে।

জামা ধুয়ে মুছে ওরা যখন ফিরল তখন কেক খাচ্ছে সবাই।

ওর পাশে যে মেয়েটা বসে সেই বেকি বলল, “কেকটা অসাধারণ! কী ভালো খেতে!”

ওদের টিচার মিসেস গ্রুবারও বললেন, “হ্যাঁ, কেকটা খুবই ভালো খেতে হয়েছে। কী নরম আর একটুও বেশি মিষ্টি নয়!”

বৃষ্টি তাই শুনে বলল, “ও আরিয়ানার বেকারির কেক তো? আমারও একটু চাই, আমি কেক পাইনি।”

বেকি ওর কথা শুনে বলল, “না, না, এটা আরিয়ানার বেকারির কেক নয়। ওর কেকটাতে প্রচুর ক্রিম দেওয়া আছে। আমি তো ক্রিম খাই না, মিসেস গ্রুবারও খান না। এটা অন্য কারো আনা। অন্য একটা কৌটোতে এই কেকটা ছিল, কিন্তু কারো নাম লেখা ছিল না তাতে। কে এনেছে জানি না তবে খুব ভালো খেতে।”

আরো কয়েকজন বন্ধুও যোগ দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, দারুণ খেতে ওই কেকটা!”

বৃষ্টির মুখ হাঁ হয়ে গেল। কোন রকমে ঢোঁক গিলে সে বলল, “আমি, আমি এনেছি ওই কেকটা!”

মিসেস মিলার আর মিসেস গ্রুবার দুজনেই মার তৈরি কেকের টুকরোতে কামড় দিয়ে বললেন, “বাহ, দারুণ খেতে হয়েছে কেকটা। কোথা থেকে কিনেছো বলো তো?”

গর্বে বুক ফুলিয়ে বৃষ্টি বলল, “এটা কোন দোকান থেকে কেনা কেক নয়! এটা আমার মা বাড়িতে বানিয়েছে!”

GolpoKotha
GolpoKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments