Wednesday, June 18, 2025
Homeগল্প কথাচিতার বাসায় বলগা হরিণ

চিতার বাসায় বলগা হরিণ

চিতার বাসায় বলগা হরিণ

ব্রাজিলের এক জঙ্গলে উদাস মনে হাঁটছিল এক বলগা হরিণ। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে ভাবনা উদয় হলো, জীবনের প্রায় অর্ধেকটা কেটে গেল, ঘর-দুয়ার কিছুই হলো না। আর কতকাল এ ভবঘুরে জীবন কাটাবে! কোথাও স্থির হয়ে বসা দরকার।

ভাবতে ভাবতে এক সময় হরিণটি একটি সুন্দর নদীর ধারে এসে থামল। কি সুন্দর নির্মল স্বচ্ছ নদীর জল, কি সুন্দর তার ঢেউ, দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায়। হরিণ দেখল, উত্তর পশ্চিম কোণে যেখানটাতে নদীটি বাঁক নিয়েছে তার পাশের জায়গাটা অনেক সুন্দর। চাইলেই এখানে একটি বাড়ি বানানো যায় অনায়াসে। তারপর হরিণ মনস্থির করল, তার পছন্দের সেই জায়গাতে একটি বাড়ি বানাবে। অতঃপর হরিণ তার অন্য কাজে জঙ্গলের আরও গভীরে চলে গেল।

হরিণ চলে যাওয়ার পর সে স্থানে আসলো একটি বিশাল চিতাবাঘ। নদীর বিশালতায় সেও মুগ্ধ হয়ে গেল। কাকতালীয়ভাবে হরিণের পছন্দের জায়গাটা তারও বেশ ভাল লাগলো। চিতাও চিন্তা করল এখানটাতেই সে একটি বাড়ি বানাবে। তারপর চিতাও হরিণের মতো তার কাজে চলে গেল জঙ্গলের অন্যদিকে।

এদিকে কিছুক্ষণ পর হরিণ ফিরে এসে কাজে নেমে পড়ল, তারা শাখা প্রশাখাযুক্ত শিংয়ের ঘায়ে তার পছন্দের জায়গার ঝোপ-ঝাড় গাছ-পালা সব কেটে সাফ করে ফেলল। পা দিয়ে মাড়িয়ে মাটিও সমান করে ফেলল, তারপর হরিণ আবার জঙ্গলের গভীরে চলে গেল।

এমন সময় আসল চিতাবাঘ, তার পছন্দের জায়গাটি এমন সুন্দর করে পরিষ্কার এবং সমান করা দেখে ভাবল, এটা নিশ্চিত দেবতা টুপ্যানের আশীর্বাদ। আমি টুপ্যানের আশীর্বাদপুষ্ট, তাই তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। টুপ্যানের পূজারী চিতাবাঘটি তখনি চরম উৎসাহে তার ধারালো নখ এবং থাবা দিয়ে মেঝের কাজটি শেষ করে ফেলল। তারপর সেও আবার জঙ্গলের অন্যদিকে চলে গেল।

চিতাবাঘ চলে যাওয়ার পর হরিণ এসে দেখে তার বাসার মেঝের কাজ কে যেন শেষ করে গেছে। হরিণও ভাবল একই কথা, এ কাজ মহাপ্রভু টুপ্যানের। আমি সারাক্ষণ তার উপাসনা করি বিধায় তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। টুপ্যানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে মেঝের চারপাশে দেয়াল বানিয়ে ফেলল খুব দ্রুত। কাজ শেষে সে আবার চলে গলে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

এদিকে চিতা ফিরে এসে দেখতে পেল, মহাপ্রভু টুপ্যান তার ঘরের দেওয়াল তৈরি করে দিয়েছে। এখন তার একটি ছাদ তৈরি করতে হবে। তাৎক্ষণিক সে ছাদ তৈরির কাজে নেমে পড়ল। শক্তিশালী চিতা তার পেশির জোরে খুব দ্রুতই ছাদের কাজ শেষ করে ফেলল। তারপর যথারীতি সে অন্য কাজে চলে গেল।

এদিকে হরিণ এসে আনন্দে আটখানা। টুপ্যানের অপার কৃপায় তার ঘর তৈরি হয়ে গেছে। হরিণ মহা আনন্দে ঘরে ঢুকল এবং দুটি কক্ষ বানালো একটি তার জন্য আরেকটি প্রভু টুপ্যানের জন্য। তারপর হরিণ ক্লান্ত হয়ে তার কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙতেই দেখত পেল চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। সূর্য তখন ডুবে গেছে।

এদিকে সন্ধ্যা নামলে চিতাবাঘও ফিরে আসল এবং দেখতে পেল ঘরের ভেতর দুটি কক্ষ বানানো, চিতা ভাবল এ কাজ টুপ্যানেরই। নিশ্চয়ই একটি কক্ষ তার জন্য অপরটি টুপ্যানের জন্য। সে একটি কক্ষে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। চিতা ভাবল এক বাসায় সে এবং টুপ্যান পাশাপাশি কক্ষে ঘুমাচ্ছে। হরিণও ভাবল চিতার মতোই। এভাবে সারারাত চিতা ও হরিণ এক বাসায় পাশাপাশি কাটিয়ে দিল সারারাত।

সকালে চিতা ও হরিণ একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে একে অপরকে দেখল। চিতা হরিণকে জিজ্ঞেস করল, তুমিই কি আমাকে ঘর বানাতে সাহায্য করেছিলে? হরিণ জবাব দিল, হ্যাঁ আমিই। হরিণও একই প্রশ্ন চিতাকে করল এবং প্রত্যাশিত উত্তরটিই পেল। তারপর উভয়ের সম্মতিতে তারা একই ঘরের দুটি কক্ষে বসবাস শুরু করল। তারা তাদের ঘর তৈরির গল্প করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর চিতা খেয়াল করল সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। চিতা তখন আগুন জ্বালিয়ে, চুলায় পানি সেদ্ধ করার একটি হাঁড়ি বসিয়ে শিকারে বেরিয়ে পড়ল। ফিরে আসল বিশাল এক বলগা হরিণ নিয়ে। সে হরিণটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। বাসায় এনে হরিণের মাংস রান্না করে পেট ভরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এ দৃশ্য দেখে হরিণটি খুব কষ্ট পেল। সারারাত হরিণ চোখ দুটি জোড় করতে পারল না, যদি চিতা এসে তাকে খেয়ে ফেলে।

সকালবেলায় হরিণ চিতাকে ডেকে বলল, চুলায় পানি গরম দাও, আমি শিকারে বের হচ্ছি।

হরিণ জঙ্গলের গভীরে চলে গেল, সেখানে সে দেখতে পেল একটি বিশাল চিতা গাছের বাকলে ঘষে তার নখে শান দিচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে হরিণ চিন্তা করল একে শক্তি দিয়ে কাবু করা যাবে না, একে কাবু করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। হরিণ পিপড়াখেকো বিষাক্ত জীব টেমানডুয়ার খোঁজ করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি শক্ত সামর্থ টেমানডুয়া পেয়ে গেল।

হরিণ টেমানডুয়াকে কাছে ডেকে চিতাবাঘটিকে দেখিয়ে বলল, এই দুষ্ট চিতাটি তোমার সম্পর্কে জঙ্গলে বাজে কথা ছড়াচ্ছে। এ কথা শুনে টেমানডুয়া রাগে গজগজ করতে করতে চিতাটির শক্ত চামড়ার ভেতর তার ধারালো নখ ঢুকিয়ে প্রচণ্ড ক্ষীপ্রতায় খোঁচাতে শুরু করল। টেমানডুয়া ততোক্ষণ পর্যন্ত খোঁচালো যতক্ষণ না এ বিশাল চিতাটি নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলো ঢলে না পড়ল। মৃত্যু নিশ্চিত করে টেমানডুয়া সে স্থান থেকে প্রস্থান করল।

মৃত চিতাটিকে হরিণ কাঁধে নিয়ে আস্তে আস্তে তাদের নতুন গৃহে ঢুকল। চিতা আগে কখনো কোনো হরিণকে মাংস খেতে দেখেনি। এ বিশাল চিতার মাংস রান্না করছে দেখে ঘরের চিতাটি ভয়ে মুষড়ে পড়ল। সে কাঁপতে কাঁপতে তার কক্ষে গিয়ে দেবতা টুপ্যানের নাম জঁপতে লাগল। তারপর হরিণও তার কক্ষে চলে গেল।

হরিণ ভয়ে অস্থির, সে কিছুতেই ঘুমাতে পারছে না, তার মনে আশঙ্কা যেকোনো সময় চিতাটি এসে তাকে খেয়ে ফেলবে। চিতার দশাও একই, সেও ঘুমাতে পারছে না হরিণের ভয়ে, যেকোনো সময় হরিণ এসে চিতাকে খেয়ে ফেলবে। এ ভাবতে ভাবতে এক সময় চিতা ঘুমিয়ে পড়ল।

হরিণেরও চোখ ছোট হয়ে আসছে। এক সময় হরিণ তার মাথাটা কাত করলে লম্বা শিং গুতা দেয় পাশের দেয়ালে। এ শব্দে বাঘ ভয়ে লাফিয়ে ওঠে, তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে ভয়ে। অতঙ্কে গর্জন করতে করতে সে ঘর থেকে পালানোর জন্য বেরুলো।

চিতার গর্জনে হরিণের ঘুম ছুটে যায়। সে ভাবল, এই বুঝি চিতা এলো তাকে খাওয়ার জন্য। সেও পালানোর জন্য দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একে অপরের ভয়ে বাঘ দৌড়াল জঙ্গলের দক্ষিণে, হরিণ দৌড়াল জঙ্গলের উত্তরে। সেই থেকে আর কখনো হরিণ আর চিতাকে এক সঙ্গে দেখা যায় না।

(সমাপ্ত)

ব্রাজিলিয়ান লোকগল্প ‘ডিয়ার অ্যান্ড জাগুয়ার’ অবলম্বনে রচিত

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments