এক ভিক্ষুক ও রাজার গল্প
এক সময়ের কথা। “রাজগড়” নামে এক সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল, যেখানে রাজা বীরসিংহ শাসন করতেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, তবে তার মধ্যে গর্বেরও কিছুটা ছাপ ছিল। নিজের বুদ্ধি ও বিপুল ধনসম্পদের উপর তার প্রচণ্ড অহংকার ছিল।
একদিন রাজসভায় এক রহস্যময় ভিক্ষুক প্রবেশ করল। তার পরনে ছিল ছেঁড়া-ফাটা পোশাক, কিন্তু চোখ দুটো যেন আলো ছড়াচ্ছিল। সে সরাসরি রাজাকে বলল, “মহারাজ, আমি আপনার থেকেও বেশি ধনী।”
পুরো রাজসভা হেসে উঠল। রাজাও জোরে হেসে বললেন, “ওরে মূর্খ! তোর কাছে তো ছেঁড়া কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই, তুই কীভাবে ধনী হবি?”
ভিক্ষুক শান্তভাবে হাসল এবং বলল, “মহারাজ, যদি আমি প্রমাণ করে দিই যে আমি আপনার থেকেও বেশি ধনী, তাহলে আপনি কি আমাকে কিছু উপহার দেবেন?”
রাজা কটাক্ষ করে বললেন, “যদি তুই সেটা প্রমাণ করতে পারিস, তাহলে আমি আমার অর্ধেক রাজ্য তোকে দিয়ে দেব!”
ভিক্ষুক সেই শর্ত মেনে নিল এবং বলল, “আমি আপনার কাছে সাত দিনের সময় নিচ্ছি। সপ্তম দিনে আমি আপনাকে আমার আসল ধন দেখাব।”
রাজার কাছে বিষয়টা বেশ আকর্ষণীয় লাগল, তিনি চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন।
সপ্তম দিন ভিক্ষুক আসলে, রাজা কথা শুরু করলেন। রাজা ভিক্ষুককে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সবচেয়ে বড় সম্পদ কী?”
ভিক্ষুক বলল, “সন্তুষ্টি। যা পাই, তাতেই খুশি থাকি। আপনি কি আপনার অগাধ ধনে সন্তুষ্ট?”
রাজা কিছুটা অবাক হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
ভিক্ষুক আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি প্রতিরাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারেন?”
রাজা বললেন, “সব সময় পারি না, রাজ্যের চিন্তা মাথায় থাকে।”
ভিক্ষুক হেসে বলল, “আর আমি প্রতিদিন নিশ্চিন্তে ঘুমাই। দেখুন, আমার ধন আরও বেড়ে গেল!”
এরপর সে প্রশ্ন করল, “আপনার অসংখ্য ধনদৌলত আছে, কিন্তু কেউ কি নিঃস্বার্থভাবে আপনাকে ভালোবাসে?”
এই প্রশ্নে রাজা নীরব হয়ে গেলেন। তার মনে পড়ে গেল, দরবারে সবাই স্বার্থ নিয়ে আসে, নিঃস্বার্থ কেউ নেই।
ভিক্ষুক বলল, “মহারাজ, আপনি কি কখনও মুক্তভাবে জীবন উপভোগ করেছেন?”
রাজা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “রাজকার্যের দায়িত্বে আমি সাধারণ জীবনের আনন্দ কখনও পাইনি।”
ভিক্ষুক তখন বলল, “আমি প্রতিদিন আনন্দে বাঁচি। তাই আমার সম্পদ আরও বেড়ে যায়!”
এই কথাগুলো শুনে রাজার মনে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি রেগে গিয়ে ভিক্ষুককে বন্দী করার আদেশ দিলেন। তখন ভিক্ষুক শান্তভাবে হেসে বলল, “মহারাজ, আপনি জানেন না, কাকে বন্দী করছেন।”
রাজা চমকে উঠলেন।
ভিক্ষুক বলল, “মহারাজ, আগামীকাল শেষ দিন। তখনই আমি আমার আসল সম্পত্তি আপনার সামনে আনব।”
পরদিন পুরো রাজসভা উপস্থিত ছিল। ভিক্ষুক ধীর হেসে বলল, “মহারাজ, আমি কোনও সাধারণ ভিক্ষুক নই। আমি আপনারই বড় ভাই। যাকে সিংহাসনের জন্য বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু আমি বেঁচে গিয়েছিলাম এবং তখন থেকেই সত্যিকারের সুখের খোঁজে পথে নেমেছিলাম। আজ বলুন, কার কাছে বেশি ধন?”
রাজা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার শৈশবের হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের স্মৃতি ভেসে উঠল। তিনি আবেগে ভেঙে পড়লেন, ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন।
তারপর রাজা তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিংহাসনের অর্ধেক ভাগ বড় ভাইকে দিয়ে দিলেন।
শিক্ষা:
এই গল্প থেকে বোঝা যায়, সত্যিকারের ধন কোনো বস্তু বা টাকার পরিমাণ নয়, বরং তা হলো সন্তুষ্টি, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, এবং মানসিক শান্তি।