Tuesday, May 13, 2025
Homeকিশোর গল্পইঁদুর আর বিড়ালের কথা – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

ইঁদুর আর বিড়ালের কথা – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

ইঁদুর আর বিড়ালের কথা – উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কোন এক বনে বহুকালের পুরাতন এক প্রকাণ্ড বটগাছ ছিল। সেই বটগাছে গোড়ায় পলিত নামে একটি অতিশয় বুদ্ধিমান ইঁদুর শতমুখ বিশিষ্ট সুন্দর গর্তে বাস করিত। ঐ গাছের ডালে কত পাখির বাসা ছিল, তাহার সংখ্যা নাই। লোমশ নামে এক দুষ্ট বিড়াল, সেই-সকল পাখির ছানা খাইবার জন্য, সেই গাছে থাকিত।

ইহার মধ্যে পরিঘ নামক এক বিকটাকার ব্যাধ সেই বনে আসিয়া কুঁড়ে বাঁধিল। সে প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে, ঐ গাছের নিকটে ফাঁদ পাতিয়া মাংসের টুকরা ছড়াইয়া রাখিত, আর সকালে আসিয়া দেখিত, তাহাতে অনেক জন্তু ধরা পড়িয়াছে। একদিন সেই ফাঁদে পাখিরছানা-খেকো দুষ্ট বিড়ালটা আটকা পড়িল।

ইঁদুরটিরও বড়ই ইচ্ছা হইত যে, সেই টুকটুকে মাংসের একটু খানি চাখিয়া দেখে। কিন্তু দুরন্ত বিড়াল গাছের আড়াল হইতে ক্রমাগতই তাহাকে ধরিবার চেষ্টায় থাকাতে আর তাহার সে সাধ মিটাইবার সুযোগ হইত না। আজ সেই শত্রু ফাঁদে পড়িয়াছে, সুতরাং ইদুরের বড়ই আনন্দ। সে ফাঁদের নিকটে আসিয়া মনের সুখে মাংস খাইতে লাগিল; বিড়ালকে গ্রাহ্যই করিল না।

এমন সময় সেই ইঁদুরের গন্ধ পাইয়া, হরিত নামক একটা অতি ভীষণ এবং নিতান্ত নিষ্ঠুর নেউল তাহাকে খাইবার জন্য, ঠোঁট চাটিতে চাটিতে আসিয়া গর্তের ভিতর হইতে উকি মারিল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রক নামে সাক্ষাৎ মৃত্যুর ন্যায় ভয়ঙ্কর একটা প্যাঁচা, গাছের উপর হইতে তাহার উপর ছো ঁমারিবার আয়োজন করিল। সেই নেউলের রাঙা রাঙা চোখ, আর প্যাঁচার সাংঘাতিক ঠোট আর নখ দেখিয়া, ইঁদুর বেচারার ত আর ভয়ের সীমা পরিসীমা রহিল না। সে তখন এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিল যে, এখন কি করিয়া এই বিষম বিপদ হইতে রক্ষা পাই? একমাত্র এই বিড়াল এখন আমাকে বাঁচাইতে পারে, সুতরাং ইহার সহিত বন্ধুতা করা নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে।

এই মনে করিয়া সে বিড়ালের নিকট গিয়া বলিল, “কেমন আছ ভাই? একটা কথা শুনিবে? দেখ, এখন তোমারও নিতান্ত বিপদ; আমারও নিতান্ত বিপদ; কিন্তু তোমাতে আমাতে বন্ধুতা হইলে দুজনেরই বিপদ সহজে কাটিতে পারে।”

বিড়াল আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন করিয়া?”

ইঁদুর বলিল, “দেখ, ঐ দুষ্ট নেউল আর প্যাঁচা আমাকে ধরিয়া খাইবার জন্য কেমন ব্যস্ত হইয়াছে। উহাদিগের পানে তাকাইলে আর আমার এক মুহূর্তের তরেও প্রাণের আশা থাকে না। এখন তুমি যদি আমাকে হিংসা না কর, তবেই তোমার কোলের কাছে বসিয়া আমি উহাদের হাত হইতে বাঁচিতে পারি। তারপর আমি তোমার বাঁধন কাটিয়া দিলে, তুমিও নিশ্চিন্তে ঘরে চলিয়া যাইতে পার।”

বিড়াল দেখিল, বাস্তবিকই ইঁদুররের কথা মত কাজ করা ভিন্ন তাহাদের রক্ষা পাওয়ার আর উপায় নাই। সুতরাং সে আনন্দের সহিত তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইল। তখন সেই ইঁদুরের মনে কি আনন্দ যে হইল, তাহা কি বলিব? বিড়ালের নিজের ছানাও বোধহয় তাহার কোলে এমন আরামের সহিত গিয়া লুকাইতে পারিত না, যেমন সেই ইঁদুর গিয়া লুকাইল!

এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়া নেউল আর প্যাঁচা কি করিবে, কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তাহারা খানিক বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাকাইয়া, চোরের মত সেখান হইতে পলাইয়া গেল।

তারপর ইঁদুর বিড়ালকে অনেক ধন্যবাদ দিয়া, ধীরে সুস্থে তাহার বাঁধন কাটিতে আরম্ভ করিল। বিড়াল বলিল, “ভাই। একটু চটপট কর, আমার বড় লাগিতেছে।”

ইঁদুর বলিল, “ভাই, তুমি ব্যস্ত হইও না। আমি ঠিক সময়ে নিশ্চয় বাঁধন কাটিয়া শেষ করিব।”

বিড়াল বলিল, “আর কখন শেষ করিবে? আর-একটু পরে ত ব্যাধই আসিয়া উপস্থিত হইবে।

ইঁদুর বলিল, “ব্যাধ যাহাতে তোমার কোন অনিষ্ট না করিতে পারে, তাহার জন্য আমি দায়ী। কিন্তু ভাই, এখন তোমার সকল বাঁধন খুলিয়া দিলে, যদি তুমি এখনই আমাকে ভক্ষণ করিয়া ফেলিতে চাহ, তবে আমার কি দশা হইবে? তোমার কোন চিন্তা নাই। আমি সকল দড়ি কাটিয়াছি এক গাছি মাত্র বাকি আছে তাহাও আমি ঠিক সময়ে কাটিয়া দিব। ব্যাধ তোমার কিছুই করিতে পারিবে না।”

এমনি করিয়া ক্রমে রাত্রি শেষ হইয়া আসিল;তাহার খানিক পরেই ব্যাধও আসিয়া দেখা দিল। তাহা দেখিয়া বিড়াল বলিল, “সর্বনাশ! ভাই, এখন উপায়?”

ইঁদুর বলিল, “কোন চিন্তা নাই!”

এই বলিয়া সে কুট করিয়া বিড়ালের শেষ বাঁধনটি কাটিয়া দিবামাত্র বিড়াল যার পর নাই ব্যস্ত হইয়া দুই লাফে গাছে উপরে গিয়া উঠিল। ইঁদুরও সেই অবসরে তাহার গর্তে গিয়া ঢুকিল। ব্যাধ আসিয়া দেখিল, তাহার জালের বড়ই দুর্দশা হইয়াছে সুতরাং সে দুঃখের সহিত তাহা লইয়া ঘরে ফিরিল।

বিড়াল যখন দেখিল, বিপদ কাটিয়া গিয়াছে তখন সে অতিশয় মিষ্টভাবে ইঁদুরকে ডাকিয়া বলিতে লাগিল “ভাই! তখন তুমি তাড়াতাড়ি চলিয়া গেলে, আর আমি তোমাতে ধন্যবাদ দিতে পারিলাম না! তুমি আমার এত উপকার করিয়াছ, আমারও ত তোমার জন্য কিছু করিতে হয়। তুমি একটি বার আমার নিকট আইস, দেখিবে আমি তোমাকে কেমন আদর করিব।”

তাহা শুনিয়া ইঁদুর হাসিয়া বলিল, “ভাই, তুমি যাহা বলিলে তাহা সত্য। তবে কিনা, নিজের প্রাণটাকে বাঁচাইয়া চলা সকলেরই কর্তব্য। আমাকে আদর করিতে করিতে তোমার হঠাৎ ক্ষুধা হইলে, আমার বিপদ ঘটিতে পারে। তাহা ছড়া ভগবানের কৃপায় তোমার ছেলেপিলে ঢের আছে। তাহাদের বয়স অল্প বটে, কিন্তু ক্ষুধা বেশি। তাহারা বাঁচিয়া থাকুক, কিন্তু আমার পক্ষে তাহাদের সামনে না যাওয়াই ভাল।”

সুতরাং সে যাত্রা বিড়ালের আর ইদুর খাওয়া হইল না।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments