Wednesday, June 11, 2025
Homeছোট গল্পযতীনের জুতো – সুকুমার রায়

যতীনের জুতো – সুকুমার রায়

যতীনের জুতো – সুকুমার রায়

যতীনের নতুন জুতো কিনে এনে তার বাবা বললেন, “এবার যদি অমন করে জুতো নষ্ট কর তবে ওই ছেঁড়া জুতোই পরে থাকবে।”

যতীনের চটি লাগে প্রতিমাশে একজোড়া। ধুতি তার দুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। কোনো জিনিসে তার যত্ন নেই। ব‌‌ইগুলো সব মলাট ছেঁড়া, কোণ দুমড়ান, শ্লেটটা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ফাটা। শ্লেটের পেন্‌‌সিলগুলি সর্বদাই তার হাত থেকে পড়ে যায়, কাজেই ছোট ছোট টুক্‌‌রো টুক্‌‌রো। আরেকটা তার মন্দ অভ্যাস ছিল লেড্‌‌পেন্‌‌সিলের গোড়া চিবানো। চিবিয়ে চিবিয়ে তার পেন্‌‌সিলের কাঠটা বাদামের খোলার মতো খেয়ে গিয়েছিল। তাই দেখে ক্লাশের মাস্টারমশাই বলতেন, “তুমি কি বাড়িতে ভাত খেতে পাওনা?”

নতুন চটি পায়ে দিয়ে প্রথম দিন যতীন খুব সাবধানে র‌‌ইল, পাছে ছিঁড়ে যায়। সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নামে, চৌকাঠ ডিঙ্গোবার সময় সাবধানে থাকে, যাতে না ঠোক্কর খায়। কিন্তু এই পর্যন্ত‌‌ই। দুদিন পর আবার যেই কে সেই। চটির মায়া ছেড়ে দুড়্‌‌ দুড়্‌‌ করে সিঁড়ি দিয়ে নামা, যেতে যেতে দশবার হোঁচট খাওয়া, সব আরম্ভ হল। কাজেই একমাস যেতে না যেতে চটির একটা পাশ একটু হাঁ করল। মা বললেন, “ওরে, এই বেলা মুচি ডেকে সেলাই করা, না হলে একেবারে যাবে।” কিন্তু মুচি ডাকা হয় না। চটির হাঁ বেড়ে চলে।

একটা জিনিসের যতীন খুব যত্ন করত। সেটি হচ্ছে তার ঘুড়ি। যে ঘুড়িটা তার মনে লাগত সেটিকে সে সযত্নে জোড়াতাড়া দিয়ে যতদিন সম্ভব টিকিয়ে রাখত। খেলার সময়টা সে প্রায় ঘুড়ি উড়িয়েই কাটিয়ে দিত। এই ঘুড়ির জন্য কত সময়ে তাকে তাড়া খেতে হত। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে সে রান্নাঘরে গিয়ে উৎ‌পাত করত তার আঠা চাই বলে। ঘুড়ির লেজ লাগাতে কিংবা সুতো কাটতে কাঁচি দরকার হলে সে মায়ের সেলাইয়ের বাক্স ঘেঁটে রেখে দিত। ঘুড়ি উড়াতে আরম্ভ করলে তার খাওয়া-দাওয়া মনে থাকত না। সেদিন যতীন ইস্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছে ভয়ে ভয়ে। গাছে চড়তে গিয়ে তার নতুন কাপড়খানা অনেকখানি ছিঁড়ে গেছে।

ব‌‌ই রেখে চটি পায়ে দিতে গিয়ে দেখে, চটিটা এত ছিঁড়ে গেছে যে আর পরাই মুশকিল। কিন্তু সিঁড়ি নামবার সময় তার সে কথা মনে র‌‌ইল না, সে দু-তিন সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে নামতে লাগল। শেষকালে চটির হাঁ বেড়ে বেড়ে, সমস্ত দাঁত বের করে ভেংচাতে লাগল ! যেমনি সে শেষ তিনটা সিঁড়ি গেল, আর ছেঁড়া চটি তাকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে শূন্যের উপর দিয়ে কোথায় যে নিয়ে চলল তার ঠিকঠিকানা নেই।

ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে চটি যখন থামল, তখন যতীন দেখল সে কোন অচেনা দেশে এসে পড়েছে। সেখানে চরদিকে অনেক মুচি বসে আছে। তারা যতীনকে দেখে কাছে এল, তারপর তার পা থেকে ছেঁড়া চটিজোড়া খুলে নিয়ে সেগুলোকে যত্ন করে ঝাড়তে লাগল। তাদের মধ্যে একজন মাতব্বর গোছের, সে যতীনকে বলল, “তুমি দেখছি ভারি দুষ্টু। জুতোজোড়ার এমন দশা করেছ? দেখ দেখি, আর একটু হলে বেচারিদের প্রাণ বেরিয়ে যেত।” যতীনের ততক্ষণে একটু সাহস হয়েছে। সে বলল, “জুতোর আবার প্রাণ থাকে নাকি?” মুচিরা বলল, “তা না তো কি? তোমরা বুঝি মনে কর, তোমরা যখন জুতো পায়ে দিয়ে জোরে ছোটো তখন ওদের লাগে না? খুব লাগে।

লাগে বলেই তো ওরা মচ্‌‌মচ্‌‌ করে। যখন তুমি চটি পায়ে দিয়ে দুড়্‌‌দুড়্‌‌ করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করেছিলে আর তোমার পায়ের চাপে ওর পাশ কেটে গিয়েছিল, তখন কি ওর লাগেনি? খুব লেগেছিল। সেইজন্যেই ও তোমাকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। যত রাজ্যের ছেলেদের জিনিসপত্রের ভার আমাদের উপর। তারা সে সবের অযত্ন করলে আমরা তাদের শিক্ষা দেই।” মুচি যতীনের হাতে ছেঁড়া চটি দিয়ে বলল, “নাও, সেলাই কর।” যতীন রেগে বলল, “আমি জুতো সেলাই করি না, মুচিরা করে।” মুচি একটু হেসে বলল, “একি তোমাদের দেশ পেয়েছ যে করব না বললেই হল? এই ছুঁচ সুতো নাও, সেলাই কর।” যতীনের রাগ তখন কমে এসেছে, তার মনে ভয় হয়েছে। সে বলল, “আমি জুতো সেলাই করতে জানি না।” মুচি বলল, “আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, সেলাই তোমাকে করতেই হবে।”

যতীন ভয়ে ভয়ে জুতো সেলাই করতে বসল। তার হাতে ছুঁচ ফুটে গেল, ঘাড় নিচু করে থেকে থেকে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে গেল, অনেক কষ্টে সারাদিনে একপাটি চটি সেলাই হল। তখন সে মুচিকে বলল, “কাল অন্যটা করব। এখন ক্ষিদে পেয়েছে।” মুচি বলল, “সে কি ! সব কাজ শেষ না করে তুমি খেতেও পাবে না, ঘুমোতেও পাবে না। একপাটি চটি এখনও বাকি আছে। তারপর তোমাকে আস্তে আস্তে চলতে শিখতে হবে, যেন আর কোনো জুতোর উপর অত্যাচার না কর। তারপর দরজীর কাছে গিয়ে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে হবে। তরপর আর কি কি জিনিস নষ্ট কর দেখা যাবে।”

যতীনের তখন চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে কাঁদতে কাঁদতে কোনো রকমে অন্য চটিটা সেলাই করল। ভাগ্যে এ পাটি বেশি ছেঁড়া ছিল না। তখন মুচিরা তাকে একটা পাঁচতলা উঁচু বাড়ির কাছে নিয়ে গেল। সে বাড়িতে সিঁড়ি বরাবর একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। তারা যতীনকে সিঁড়ির নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল, “যাও, একেবারে পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে যাও, আবার নেমে এস। যতীন পাঁচতলা পর্যন্ত উঠে গিয়ে লেমে এল। সে নিচে আসলে মুচিরা বলল, “হয়নি।

তুমি তিনবার দুটো করে সিঁড়ি এক সঙ্গে উঠেছ, পাঁচবার লাফিয়েছ, দুবার তিনটে করে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়েছ। আবার ওঠ। মনে থাকে যেন, একটুও লাফাবে না, একটাও সিঁড়ি ডিঙ্গোবে না।” এতটা সিঁড়ি উঠে নেমে যতীন বেচারীর পা টনটন করছিল। সে এবার আস্তে আস্তে উপরে উঠল, আস্তে আস্তে নেমে এল। তারা বলল, আচ্ছা, এবার মন্দ হয়নি। তাহলে চল দরজীর কাছে।”

এই বলে তারা তাকে আর একটা মাঠে নিয়ে এল, সেখানে খালি দরজীরা বসে বসে সেলাই করছে। যতীনকে দেখেই তারা জিগ্‌‌গেস করল, “কি? কি ছিঁড়েছে?” মুচিরা উত্তর দিল, “নতুন ধুতিটা, দেখ কতটা ছিঁড়ে ফেলেছে।” দরজীরা মাথা নেড়ে বলল, “বড় অন্যায়, বড় অন্যায় ! শিগ্‌‌গির সেলাই কর।” যতীনের আর ‘না’ বলবার সাহস হল না। সে ছুঁচ-সুতো নিয়ে ছেঁড়া কাপড় জুড়তে বসে গেল। সবে মাত্র দুফোঁড় দিয়েছে অমনি দরজীরা চেঁচিয়ে উঠল, “ওকে কি সেলাই বলে? খোল, খোল।”

অমনি করে, বেচরি যতবার সেলাই করে, ততবার তারা বলে,” খোল খোল !” শেষে সে একেবারে কেঁদে ফেলে বলল, আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।” তাতে দরজীরা হাসতে হাসতে বলল, “খিদে পেয়েছে? তা তোমার খাবার জিনিস তো আমাদের কাছে ঢের আছে” , এই বলে তারা তাদের কাপড়ে দাগ দেবার পেন্‌‌সিল কতগুলো এনে দিল। “তুমি তো পেন্‌‌সিল চিবোতে ভালোবাস, এইগুলো চিবিয়ে খাও, আর কিছু আমাদের কাছে নেই।”

এই বলে তারা যার যার কাজে চলে গেল। শ্রন্ত ক্লান্ত হয়ে যতীন কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে শুয়ে পরল। এমন সময় আকাশে বোঁ বোঁ করে কিসের শব্দ হল, আর যতীনের তালি-দেওয়া সাধের ঘুড়িটা গোঁৎ‌ খেয়ে এসে তার কোলের উপর পড়ল। ঘুড়িটা ফিস্‌‌ফিস্‌‌ করে বলল, “তুমি আমাকে যত্ন করেছ, তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। শিগ্‌‌গির আমার লেজটা ধর।” যতীন তাড়াতাড়ী ঘুড়ির লেজটা ধরল। ঘুড়িটা অমনি তাকে নিয়ে সোঁ করে আকাশে উঠে গেল।

সেই শব্দ শুনে দরজীরা বড় বড় কাঁচি নিয়ে ছুটে এল ঘুড়ির সুতোটা কেটে দিতে। হঠাৎ‌ ঘুড়ি আর যতীন জড়াজড়ি করে নিচের দিকে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে যেই মাটিটা ধাঁই করে যতীনের মাথায় লাগল, অমনি সে চমকে উঠল। ঘুড়িটা কি হল কে জানে ! যতীন দেখল সে সিঁড়ির নিচে শুয়ে আছে, আর তার মাথায় ভয়ানক বেদনা হয়েছে।

কিছুদিন ভুগে যতীন সেরে উঠল। তার মা বলতেন, “আহা , সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে, এই ভোগানিতে বাছা আমার বড় দুর্বল হয়ে গেছে। সে স্ফুর্তি নেই, সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলা নেই, কিছুই নেই। তা ন‌‌ইলে এক জোড়া জুতো চার মাস যায়?”

আসল কথা— যতীন এখনও সেই মুচিদের আর দরজীদের কথা ভুলতে পারেনি।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments