Monday, August 4, 2025
Homeগোয়েন্দা গল্পরহস্য গল্পম্যাজিশিয়ান মামা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ম্যাজিশিয়ান মামা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ম্যাজিশিয়ান মামা – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

টুকাই তার বন্ধু কুট্টুসের কাছ থেকে একটা ভূতের গল্পের বই পড়তে নিয়েছিল। সারা বিকেল খেলার মাঠের শেষ দিকটায় নিরিবিলি ঝিলের ধারে বসে বইটা যখন শেষ করে ফেলল, তখন দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। খেলুড়েরা কখন চলে গেছে খেলা শেষ করে। ঝিলের ঘাটে যে ধোপা কাপড় কেচে শুকোতে দিয়েছিল, সেও তার গাধাটার পিঠে কাপড়ের বোঁচকা চাপিয়ে চলে যাচ্ছে। টুকাইয়ের এবার গা ছমছম করছিল। সে উঠে পড়ল।

কুট্টুসের কাছে অনেক ভূতের গল্পের বই আছে। টুকাই ভাবল বইটা ফেরত দিয়ে আরেকটা চেয়ে নেবে। কিন্তু এসব বই পড়ে এই সন্ধেবেলা বড্ড ভয় করে যে? কুট্টুসদের বাড়িটা আবার নিরালা জায়গায়, শহরের একটেরে। পেছনে একটা কবরখানাও আছে। সায়েবি আমলের। কুট্টুস সায়েব ভূতগুলোর কত গল্প না শুনিয়েছে। দোনামনা করে টুকাই এদিক-ওদিক তাকাতে-তাকাতে খেলার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছুল। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। লোকজন হাঁটাচলা করছে। টুকাইয়ের ভয়টা চলে গেল তাই দেখে। সে কুট্টুসদের বাড়ির দিকে চলতে লাগল।

কুট্টুসদের বাড়িটা পুরোনো হলেও বেশ সুন্দর। সামনে এক টুকরো ফুলবাগান আছে। গেটের মাথায় বোগনেভিলিয়া ফুলের ঝাপি আছে। সন্ধ্যার দিকে কেমন একটা মিঠে গন্ধ মউমউ করে। কিন্তু বাড়ির সামনে গিয়েই টুকাই একটু অবাক হল।

বাড়িতে আলো জ্বলছে না। কুট্টুসরা নেই নাকি? টুকাই গেট দিয়ে উঁকি মেরে আস্তে ডাকল,–কুট্টুস!

অমনি অন্ধকার বারান্দা থেকে কেউ ভারী গলায় বলে উঠল, কে রে?

তাহলে বাড়িতে লোক আছে। গলাটাও যেন চেনা লাগছে। টুকাই বলল, আমি।

–আমি? আমি কে হে? আমি কি কারুর নাম হয় নাকি?

টুকাই ধমক খেয়ে হকচকিয়ে বলল, আমি টুকাই।

–টুকাই? সে আবার কে? কই, সামনে এসো তো দেখি?

টুকাই ভয়ে-ভয়ে গেট খুলে ভেতরে গেল। রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে টেরচা হয়ে ফিকে হলদে রঙের একটুখানি আলো বারান্দায় গিয়ে পড়েছে। সেই আলোয় টুকাই এতক্ষণে দেখতে পেল, কুট্টুসের সেই ম্যাজিশিয়ান-মামা বেতের চেয়ারে বসে আছেন।

অমনি সে খুশিতে নেচে উঠল। ভয়টুকু আর রইল না। কুটুর এই মামা নামকরা ম্যাজিশিয়ান। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন এখানে। কুট্টুসের বন্ধুদের কত মজার ম্যাজিক দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।

কিন্তু কুট্টুস তো বলেনি ওর ম্যাজিশিয়ান-মামা এসেছেন। টুকাই মনে-মনে কুট্টুসের ওপর রেগে গেল। ম্যাজিশিয়ান-মামা ফের ধমক দিয়ে বললেন, কী হল?

অমন করে দাঁড়িয়ে আছো যে বড়? কাছে এসো, দেখি তুমি কে?

টুকাই হাসিমুখে বারান্দায় উঠে বলল, আমি টুকাই ম্যাজিশিয়ান-মামা! আমাকে চিনতে পারছেন না? তারপর ঢিপ করে পায়ে একটা প্রণামও করে ফেলল। ম্যাজিশিয়ান-মামা খুশি হয়ে বললেন,–হুঁ, মনে পড়েছে বটে। তুমি টুকাই।

টুকাই বললে, কখন এলেন ম্যাজিশিয়ান-মামা? কুট্টুস তো আমাকে বলেনি।

বলবার সময় পেলে তো! –ম্যাজিশিয়ান-মামা বললেন, আমিও এলুম, ওরাও বাড়িসুদ্ধ গেল কোন বিয়েবাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। তাই একা বসে বাড়ি পাহারা দিচ্ছি। তা তোমায় পেয়ে ভালোই হল। কথাবার্তা বলা যাবে।

টুকাই বলল,–ম্যাজিক দেখাতে হবে কিন্তু, ম্যাজিশিয়ান-মামা।

দেখাব, দেখাব। –ম্যাজিশিয়ান-মামা একটু হাসলেন, তোমাদের ম্যাজিক দেখিয়ে বড় আনন্দ পাই। কিন্তু দেখছ, বাড়িতে কারেন্ট নেই–লোডশেডিং। ওই দেখো, সব বাড়িতে আছে। শুধু এই বাড়িটা বাদে। ভারি অদ্ভুত মনে হচ্ছে না তোমার?

টুকাই দেখে নিয়ে বলল, হ্যাঁ ম্যাজিশিয়ান-মামা।

–তা যাকগে। অন্ধকার ভালো। বুঝলে? অন্ধকার আমি খুব পছন্দ করি।

টুকাই সায় দিয়ে বলল, আমিও পছন্দ করি ম্যাজিশিয়ান-মামা।

–করো বুঝি? তুমি খুব ভাল ছেলে। ম্যাজিশিয়ান-মামা বললেন,–তা তোমার হাতে ওটা কী?

–একটা ভূতের গল্পের বই, ম্যাজিশিয়ান-মামা। কুট্টুসকে ফেরত দিতে এলুম।

–অ্যাঁ! ভূতের গল্পের বই? কই, দেখি-দেখি!

ম্যাজিশিয়ান-মামা বইটা টুকাইয়ের হাত থেকে টেনে নিলেন। টুকাই মিটমিট করে হেসে বলল, অন্ধকারে দেখবেন কী করে?

–আমি অন্ধকারে দেখতে পাই। বুঝলে তো?

টুকাই ভাবল, ম্যাজিশিয়ানরা কত অদ্ভুত-অদ্ভুত ম্যাজিক দেখাতে পারেন। তাছাড়া চোখে রুমাল বেঁধে থটরিডিংয়ের খেলাও যখন দেখান, তখন অন্ধকারে বই পড়াটা কী এমন কঠিন ওঁদের পক্ষে। সে অবাকচোখে ম্যাজিশিয়ানমামার দিকে তাকিয়ে রইল। এও একটা দারুণ ম্যাজিক বইকী!

ম্যাজিশিয়ান মামার চেহারা এতক্ষণে আবছা দেখা যাচ্ছে। প্রকাণ্ড মানুষ। মাথায় টাক আছে। পরনে সেই বরাবর দেখা পাঞ্জাবির ওপর নকশাদার কালো জহরকোট। সেই পেল্লায় গোঁফ। উনি বইটা উলটে-পালটে দেখে বললেন, ভূতের ছবিও আছে দেখছি। কিন্তু দেখো বাপু, যে এই ছবি এঁকেছে, সে কস্মিনকালেও ভূত কেন, ভূতের টিকিও দেখেনি। ছ্যা-ছা! ভূতের চেহারা কি এমন বিচ্ছিরি?

টুকাই হাসতে-হাসতে বলল,-কেমন হয় ম্যাজিশিয়ান-মামা?

–দেখবে নাকি?

–হুঁ-উ।

–কিন্তু এই অন্ধকারে দেখবে কী করে। একটা মোমবাতি চাই যে। চলো, ভেতরে গিয়ে খুঁজে দেখি।

ঘরে ঢুকে ম্যাজিশিয়ান-মামা অন্ধকারে খোঁজাখুঁজি করে মোমবাতি জোগাড় করলেন। এটা ওঁর পক্ষে কঠিন কাজ নয়, টুকাই জানে। সে বলল,–ম্যাজিশিয়ান মামা, দেশলাইকাঠি ছাড়া মোমা জ্বালাতে পারেন না ম্যাজিক দিয়ে?

পারি বইকী। বলে ম্যাজিশিয়ান-মামা ফুঁ দিলেন। আর অবাক কাণ্ড, মোমবাতিটা দপ করে জ্বলে উঠল। টুকাই খুব হাসতে লাগল মজা পেয়ে। ম্যাজিশিয়ান মামার কত মজার মজার ম্যাজিক সে দেখেছে, এমন ম্যাজিক দেখেনি তো?

টুকাই মনে করিয়ে দিল, ম্যাজিশিয়ান-মামা, এবার ভূতের চেহারা দেখব।

–ভূতের চেহারা তোমায় বললুম না? কখনও এই বইয়ে আঁকা ছবির মতো বিচ্ছিরি হয় না।

–কেমন হয়?

–এই তোমার-আমার মতো।

টুকাই মাথা নেড়ে বলল, উঁহু। তাহলে সবাই ভূতকে ভয় পায় কেন শুনি?

বোকারাই ভয় পায়। –মোমবাতিটা টেবিলে আটকে দিয়ে ম্যাজিশিয়ান মামা চেয়ারে বসলেন। তুমি যদি বোকা হও, তুমিও ভয় পাবে। তুমি কি বোকা?

টুকাই আরও জোরে মাথা নাড়ল।

ম্যাজিশিয়ান-মামা বললেন, ভূতের চেহারা ভদ্রলোকের মতে, যেমন ধরো, আমি…

কথা কেড়ে টুকাই হাসতে-হাসতে বলল,-যাঃ! আপনি কি ভূত নাকি?

–কে বলতে পারে? এই যে এই সন্ধ্যাবেলা তুমি এই অন্ধকার বাড়িটাতে এলে–কে বলতে পারে তুমি ভূত, না মানুষ।

টুকাই হেসে অস্থির হল। ম্যাজিশিয়ান-মামা খুব আমুদে মানুষ, তা সে বরাবর দেখেছে। বলল, আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান-মামা, ভূতেরা কি ম্যাজিক দেখাতে পারে?

–হুঁ-উ! খুব পারে। তবে ভূতের ম্যাজিক তো। আরও অদ্ভুত। দেখবে নাকি? বলে ম্যাজিশিয়ান মামা প্যাচালো নাট থেকে বন্টু খোলার মতো নিজের প্রকাণ্ড মাথাটা কয়েক পাক ঘুরিয়ে দিলেন। অমনি তার মুণ্ডু বাই-বাই করে ঘুরতে থাকল। টুকাই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছিল। এতক্ষণে তার গা ছমছম করতে লাগল। চোখদুটো বড় হয়ে উঠল। এ যে বড় সাঙ্ঘাতিক ম্যাজিক।

ম্যাজিশিয়ান-মামার মুণ্ডুর ঘূর্ণি থামল। তখন চোখ নাড়িয়ে বললেন, কেমন ম্যাজিক? এর নাম হল হল মুত্যু। এবার এইটে দেখো। এ আমার নতুন ম্যাজিক। এর নাম হল জ্বলন্ত মোমবাতি ভক্ষণ।

এবার উনি আস্ত মোমবাতিটা মুখে পুরে কোত করে গিলে ফেললেন। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। টুকাই ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ম্যাজিশিয়ান-মামা! ম্যাজিশিয়ান মামা!

মোমবাতিটা হঠাৎ ম্যাজিশিয়ান-মামার টাক ফুঁড়ে বেরুল। ঘর আলোকিত হল আগের মতো। উনি ফিক করে হেসে বললেন, ভয় পেয়েছিলে বুঝি? এটা তত কিছু ভয়ের না। তবে এই তিন নম্বর খেলাটা…

টুকাই চেঁচিয়ে উঠল ফের, আর না। আর না। তারপর সটান দরজা দিয়ে ছিটকে বেরুল এবং বারান্দা থেকে এক লাফে নেমে গেট পেরিয়ে দৌড়-দৌড়! এ কখনও ম্যাজিক নয়। এ যে বড্ড ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা। মুনৃত্য, জ্বলন্ত মোমবাতি ভক্ষণ; তারপর তিন নম্বরটা হয়তো টুকাই ভক্ষণ। বাপস!…

পরদিন স্কুলে কুট্টুসের সঙ্গে দেখা। কুট্টুসকে কিছু বলার আগেই সে চোখ পাকিয়ে তেড়ে এল। টুকাই আর কখনও তোকে বই দেব না। অমন করে জানলা গলিয়ে বইটা ছুঁড়ে ফেলে এসেছিস। মলাট ছিঁড়ে কী অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?

টুকাই কঁচুমাচু মুখে বলল, যাঃ! ছুঁড়ে দিয়ে আসব কেন? বইটা তো তোর ম্যাজিশিয়ান-মামাকে দিয়ে এসেছিলুম। উনিই দেখতে নিলেন যে!

কুট্টুস আরও খাপ্পা হয়ে বলল,-চালাকির জায়গা পাসনি? ওঁকে কোথায় পেলি? ম্যাজিশিয়ান-মামা তো আমেরিকায় ম্যাজিক দেখাতে গেছেন। এখন সানফ্রান্সিসকোতে ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। কাগজে ছবি বেরিয়েছে না?

টুকাই ঢোক গিলে বলল, তাহলে কাল সন্ধেবেলা তোদের বাড়িতে কাকে দেখলুম রে?

কুট্টুস ঘুষি পাকিয়ে বলল,–ফের চালাকি?

টুকাই চুপচাপ কেটে পড়ল তার সামনে থেকে। হুঁ, খুব বেঁচে গেছে কাল সন্ধেবেলা। তবে দোষ তো কুট্টুসদেরই। কবরখানার কাছে বাড়ি খালি রেখে অমন করে–নেমন্তন্ন খেতে যায় কেউ?…

GolpoKotha
GolpoKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments