মজার গল্প – জিদ – জসীম উদ্দীন
এক ছিল তাঁতি আর তার বউ! তারা ছিল খুবই গরিব। কোনোদিন খায়, আবার কোনোদিন খেতে পায় না। তাঁত খুঁটি চালিয়ে আর কাপড় বুনে, কিইবা তাদের আয়?
আগেকার দিনে তারা বেশি উপার্জন করত। তাদের হাতের একখানা শাড়ি পাওয়ার জন্য কত বাদশাজাদীরা, কত নবাবজাদীরা তাদের উঠানে গড়াগড়ি পাড়ত।
তখন একখানা শাড়ি বুনতে মাসের পর মাস লাগত। কোনো কোনো শাড়ি বুনতে বৎসরেরও বেশি সময় ব্যয় হত।
সেইসব শাড়ি বুনতে কতই না যত্ন নিতে হত। রাত থাকতে উঠে তাঁতির বউ চরকা নিয়ে ঘড়র-ঘড়র করে সুতা কাটত। খুব ধরে ধরে চোখে নজর আসে না, এমনই সরু করে সে সুতা কাটত। ভোরবেলায় আলো-আঁধারির মধ্যে সুতাকাটা শেষ করতে হত। সূর্যের আলো যখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত, তখন সুতা কাটলে সুতা তেমন মুলাম (নরম) হত না।
তাঁতি আবার সেই সুতায় নানারকমের রঙ মাখিয়ে নিত। এত সরু সুতা আঙুল দিয়ে ধরলে ছিঁড়ে যায়। তাই, বাঁশের সরু শলার সঙ্গে আটকে, সেই সুতা তাঁতে পরিয়ে, কত রকমের নক্সা করে তাঁতি কাপড় বুনত। সেই শাড়ির উপর বুনট করা থাকত কত রাজকন্যার মুখের রঙিন হাসি, কত রূপকথার কাহিনী, কত বেহেস্তের (জান্নাতের) আরামবাগের (আরামের বাগান) কেচ্ছা (গল্প)। ঘরে ঘরে মেয়েরা সেই শাড়ি পরে যখন হাঁটত, তখন সেই শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কত গোলেবাকওয়ালী আর কত লুবানকন্যার কাহিনী ছড়িয়ে পড়ত।
শাড়িগুলির নামই বা ছিল কত সুন্দর। কলমি ফুল, গোলাপ ফুল, মন-খুশি, রাসমণ্ডন, মধুমালা, কাজললতা, বালুচর। শাড়িগুলির নাম শুনেই মন জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কিসে কি হয়ে গেল! দেশের রাজা গেল। রাজ্য গেল। দেশবাসী পথের ভিখারি সাজিল। বিদেশী বণিক এসে শহরে কাপড়ের কল বসাইল। কলের ধুয়ার (ধোয়া) উপর সোয়ার হয়ে হাজার হাজার কাপড় ছড়িয়ে পড়তে লাগল; যেমন সস্তা তেমনই টেকসই। আবার যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। তাঁতির কাপড় কে আর কিনতে চায়!
হাট হতে নক্সী-শাড়ি ফিরিয়ে এনে তাঁতিরা কাঁদে। শূন্য হাঁড়িতে চাউল না পেয়ে তাঁতির বউ কাঁদে। ধীরে ধীরে তারা সেই মিহিন (অতি চিকণ ও সুক্ষ্ণ) শাড়ি বুনান ভুলে গেল। এখনকার লোক নক্সা চায় না। তারা চায় টেকসই আর সস্তা কাপড়। তাই তাঁতি মিলের তৈরি মোটা সুতার কাপড় বুনায়। সেই সুতা আবার যেখানে-সেখানে পাওয়া যায় না। চোরাবাজার হতে বেশি দামে কিনতে হয়। এখন কাপড় বেচে (বিক্রি করে) যা লাভ হয়, তাতে কোনোরকমে শুধু বেঁচে থাকাই যায়। এটা ওটা কিনে মনের ইচ্ছামতো খাওয়া যায় না।
কিন্তু তাঁতির বউ সেকথা কিছুতেই বুঝতে পারে না। সে তাঁতিকে বলে, “তোমার হাতে পড়ে আমি একদিনও ভালমতো খেতে পারলাম না। এত করে তোমাকে বলি, হাটে যাও। ভালমতো একটা মাছ কিনে আন। সেকথা কানেই তোল না।”
তাঁতি উত্তর করে এই সামনের হাটে গিয়ে তোমার জন্য ভালমতো একটা মাছ কিনে আনব।”
সে হাট যায়, পরের হাট যায়, আরও এক হাট যায়, তাঁতি কিন্তু মাছ কিনে আনে না।।
সেদিন তাঁতির বউ তাঁতিকে ভাল করেই ধরিল, “এ হাটে যদি মাছ কিনে না আনবে তবে থাকল পড়ে তোমার চরকা, রইল পড়ে তোমার নাটাই, আমি আর নলি কাটব না। রইল পড়ে তোমার শলা, আমি আর তেনা কাড়াব না। শুধু শাক ভাত আর শাক ভাত, খেতে খেতে পেটে চর (স্তর) পড়ে গেল। তাও যদি পেট ভরে খেতে পাইতাম!”
তাঁতি কি আর করে? একটা ঘষা পয়সা ছিল, তাই নিয়ে তাঁতি হাটে গেল। এ দোকান ও দোকান ঘুরে অনেক দর দাম দস্তুর করে সেই ঘষা পয়সাটা দিয়ে তাঁতি তিনটি ছোট্ট মাছ কিনে আনল।
মাছ দেখে তাঁতির বউ কি খুশি! আহ্লাদে আটখানা হয়ে সে মাছ কুটিতে (কাটতে) বসল। এভাবে ঘুরিয়ে, ওভাবে ঘুরিয়ে কত গুমর করেই সে মাছ কাটল! যেন সত্য সত্যই একটা আস্ত বড় মাছ কাটছে। তারপর পরিপাটি করে সেই মাছ রান্না করে তাঁতিকে খেতে ডাকল।
তাঁতি আর তার বউ খেতে বসল। তিনটি মাছ। কে দুইটি খাবে, আর কে একটি খাবে, কিছুতেই তারা ঠিক করতে পারে না!
তাঁতি বউকে বলে, “দেখ, রোদে ঘেমে, কত দূরের পথ হেঁটে এই মাছ কিনে এনেছি। আমি দুইটি মাছ খাই। তুমি একটা খাও।”
বউ বলে, “উঁহু। তাহা হবে না। এতদিন বলে কয়ে কত মান-অভিমান করে তোমাকে দিয়ে মাছ কিনাইয়া আনলাম। আমিই দুইটি মাছ খাইব।”
তাঁতি বলে, “তা কিছুতেই হবে না।”
কথায় কথায় আরও কথা উঠে! তর্ক বেড়ে যায়। সেইসঙ্গে রাতও বাড়ে, কিন্তু কিছুতেই মীমাংসা হয় না, কে দুইটি মাছ খাবে আর কে একটি মাছ খাবে! অনেক বাদানুবাদ, অনেক কথা কাটাকাটি, রাতও অর্ধেক হল। তখন দুইজনে স্থির করল, তারা চুপ করে ঘুমিয়ে থাকবে। যে আগে কথা বলবে, সে-ই একটা মাছ খাবে।
তাঁতি এদিকে মুখ করে, তাঁতির বউ ওদিকে মুখ করে শুয়ে রইল। থালাভরা ভাত-তরকারি পড়ে রইল। রাত কেটে ভোর হল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। ভোর কেটে দুপুর হল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই।।
দুপুর কেটে সন্ধ্যা হল, কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। বেলা যখন পড়-পড়, আকাশের কিনারায় সাঁঝের কলসি ভর-ভর, পাড়ার লোকেরা বলাবলি করে, “আরে ভাই! আজ তাঁতি আর তাঁতির বউকে দেখছি না কেন? তাদের বাড়িতে তাঁতের খটর খটরও শুনি না, চরকার ঘড়র ঘড়রও শুনি না। কোনো অসুখ বিসুখ করল নাকি? আহা! তাঁতি বড় ভাল মানুষটি। বেচারা গরিব হইলে কি হয়, কারো কোনো ক্ষতি করে নাই কোনোদিন।”
একজন বলল, “চল ভাই! দেখে আসি ওদের কোনো অসুখ বিসুখ করল নাকি।”
পাড়ার লোকেরা তাঁতির দরজায় এসে ডাকাডাকি আরম্ভ করল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নাই। ভিতর হতে দরজা বন্ধ।।
তখন তারা দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে দেখল, তাঁতি আর তাঁতির বউ শুয়ে আছে। নড়ে না, চড়ে না ডাকলেও সাড়া দেয় না। তারপর গাঁয়ের মোল্লা এসে পরীক্ষা করে স্থির করল, তারা মারা গিয়েছে।
আহা কি ভালবাসারে! তাঁতি মরেছে, তার শোকে তাঁতির বউও মরে গিয়েছে। এমন মরা খুব কমই দেখা যায়। এসো ভাই আঁতর গোলাপ মাখিয়ে কাফন পরিয়ে এদের কবরে দাফন করি।
গোরস্তান সেখান হতে এক মাইল দূরে। এই অবেলায় কে সেখানে যাবে? পাড়ার দুইজন ইমানদার লোক মরা কাঁধে করে নিয়ে যেতে রাজি হল। মোল্লা সাহেব ঘোড়ায় চড়ে সঙ্গে সঙ্গে চললেন। কবর দেয়ার সময় জানাজা পড়তে হবে। গোরস্তানে মোরদা এনে নামানো হল; মোল্লা সাহেব একটি খুঁটার সঙ্গে তাঁর ঘোড়াটা বেঁধে সমস্ত তদারক করতে লাগলেন।
তাঁর নির্দেশমতো কবর খোড়া হল। তাঁতি আর তাঁতির বউকে গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে সেই কবরের মধ্যে শুইয়ে দেওয়া হল। তখনও তাহারা কথা বলে না। তাদের বুকের উপর বাঁশ চাপিয়ে দেওয়া হল। তখনও তারা কথা বলে না। তারপর যখন সেই বাঁশের উপর কোদাল কোদাল মাটি ফেলানো হতে লাগল, তখন বাঁশ-খুঁটি সমেত তাঁতি লাফিয়ে বলে উঠল, “তুই দুইটা খা, আমি একটা খাব।”
সঙ্গে ছিল দুইজন লোক আর মোল্লা সাহেব। তারা ভাবল, নিশ্চয়ই কোন বদ জিন এর কাজ। সঙ্গের দুইজন লোক মনে করল, তাঁতি যে তার বউকে দুইটা খেতে বলল, নিশ্চয়ই সে তাদের দুইজনকে খেতে বলল। তখন তাহারা ঝুড়ি কোদাল ফেলে দে-দৌড়, যে যত আগে পারে! মোল্লা সাহেব মনে করলেন, জিন নিজেই আমাকে খেতে আসতেছে। তখন তিনি তাড়াতাড়ি এসে ঘোড়ার পিঠে সোয়ার হয়ে মারলেন চাবুক। ভয়ের চোটে খুঁটি হতে ঘোড়ার দড়ি খুলে নিতে ভুলে গেলেন।
চাবুক খেয়ে ঘোড়া খুঁটি উপড়িয়ে দিল ছুট। ঘোড়া যত চলে সেই দড়িতে বাঁধা খুঁটা এসে মোল্লাসাহেবের পিঠে তত লাগে। তিনি ভাবেন, বুঝি জিন এসে তার পিঠে দাঁত ঘষতেছে। তখন তিনি আরও জোরে জোরে ঘোড়ার গায়ে চাবুক মারেন, আর দড়ি সমেত খুঁটা এসে আরও জোরে জোরে তার পিঠে লাগে।
হাঁসতে হাঁসতে তাঁতি আর তাঁতির বউ বাড়ি এসে ভাত খেতে বসল।