Sunday, June 29, 2025
Homeভৌতিক গল্পমড়ার খুলি ও মামা – মানবেন্দ্র পাল

মড়ার খুলি ও মামা – মানবেন্দ্র পাল

মড়ার খুলি ও মামা – মানবেন্দ্র পাল

আর একটু হলেই বুলুটা বাস চাপা পড়ত। এমন অসাবধানে রাস্তা পার হয়, কথাটা বলল আমার ভাইঝি রীণা। বুলু ওর ক্লাসফ্রেন্ড। রীণার কাকু, কাজেই বুলুরও আমি কাকু। সম্প্রতি নেপাল ঘুরে এল। এখানে এসে এতক্ষণ বাড়ির সকলের কাছে নেপালের গল্প করছিল। আমি ছিলাম না। তাই আমার জন্যে একটুকরো স্লিপ রেখে গেছে।

স্লিপটা আমার হাতে দিতে দিতে রীণা গজগজ করল, এত অসাবধান মেয়েটা, এখুনি যে কী সর্বনাশ হত!

সে কথার উত্তর না দিয়ে আমি স্লিপটা পড়তে লাগলাম।

শ্ৰীচরণেষু কাকু,

নেপালে গিয়ে দুটো মজার জিনিস পেয়েছি। শিগগির একদিন চলে আসুন।…

সেদিনই বিকেলে অফিস-ফেরত বুলুদের বাড়ি গেলাম। বাইরে-ঘরেই ওকে পাওয়া গেল। ও তখন নেপালের ওপর লেখা কয়েকটা বই থেকে কী সব নোট করছিল, আমায় দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

তারপর একটুও দেরি না করে আমায় টেনে নিয়ে গিয়ে ওর কাচের আলমারির মধ্যে রাখা দুটো মজার জিনিসের একটা দেখাল।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, এই তোমার মজার জিনিস?

ও খুব হাসতে লাগল।

মজার জিনিস নয়? এমন জিনিস ভূ-ভারতে কোথাও আর পাবেন?

তা বটে। জিনিসটা আর কিছুই নয়, একটা মড়ার খুলি। মড়ার খুলি তো অনেক দেখেছি কিন্তু এত ছোটো খুলি কখনো চোখে পড়েনি। খুলিটা স্বচ্ছন্দে হাতের মুঠোয় ধরা যায়।

কেমন? মজার জিনিস নয় ? বলে বুলু আবার হাসতে লাগল।

মজার কিনা জানি না, তবে অদ্ভুত।

এমনি সময়ে বুলুর মা চা-জলখাবার নিয়ে ঢুকলেন।

দেখুন দিকি মেয়ের কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! শাড়ি গেল, ইম্পোরটেড ছাতা গেল, ক্যামেরা গেল— শেষ পর্যন্ত এই মড়ার খুলিটা ফুটপাথ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কিনে আনল। আর তারপরেই কী বিপদ শুনেছেন তো? কাঠমাণ্ডু থেকে দক্ষিণাকালী দেখতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে একেবারে খাদে পড়ে যাচ্ছিল!

বুলুকে জিগ্যেস করলাম, এটা তো তোমার এক নম্বর মজার জিনিস, দু’নম্বরটি?

বুলু মুচকে একটু হাসল। বলল, সেটা আজ দেখানো যাবে না, যে কোনো মঙ্গল কি শুক্কুরবারে আসবেন।

বুলুর এই দুনম্বর মজার জিনিসটি যে আরো কত অদ্ভুত হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না।

মঙ্গল কি শুক্কুরবার মনে নেই। একদিন সন্ধের সময়ে বুলুদের বাড়ি গিয়ে দরজায় কলিংবেল টিপলাম। কিন্তু তখনই কেউ দরজা খুলে দিল না। এরকম বড়ো একটা হয় না। শেষে বার তিনেক বেল টেপার পর—ওদের বাড়ি যে বুড়িমানুষটি কাজ করে—সে দরজা খুলে দিল।

কিন্তু ভেতরে ঢুকেই হতাশ হয়ে গেলাম। বুঝলাম বুলু নেই, বুলুর মাও নেই।

বুড়িকে জিগ্যেস করলাম, কেউ নেই?

ও মাথা দুলিয়ে জানাল আছে। বলে বাইরে-ঘরের পর্দাফেলা দরজাটা দেখিয়ে দিল।

যাক, বুলু তা হলে আছে। মনে করে পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলাম। না, বুলু নয়। কেউ একজন কোচে গা এলিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলের ওপর দু’পা তুলে বসে আছেন। পরনে ধবধবে পা-জামা, গায়ে গিলে করা আদির পাঞ্জাবি।

ইনি যে কে তা বোঝার উপায় নেই। কেননা তিনি একখানা খবরের কাগজ মুখের ওপর আড়াল করে রয়েছেন।

কি করব ভেবে না পেয়ে জুতোর শব্দ করে সামনের কোচটা একটু টেনে নিয়ে বসলাম। কিন্তু ভদ্রলোক কাগজ সরিয়ে একবার দেখলেনও না। এমনকি শ্রীচরণ দুখানিও আমার মুখের সামনে থেকে নামালেন না।

খুবই বিশ্ৰী লাগছিল। একবার ভাবলাম উঠে চলে যাই। কিন্তু এই অতি অদ্ভুত, অদৃষ্টপূর্ব অভদ্র লোকটিকে ভালো করে না জেনেও যেতে ইচ্ছে করছিল না। অগত্যা একটা সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম।

এমনি কতক্ষণ গেল, হঠাৎ চমকে উঠলাম।

আরে! ওটা কি ?

ভদ্রলোকের কোচের একপাশে কোনোরকমে একটা ম্যাগাজিন চাপা দেওয়া সেই মড়ার খুলিটা না?

ভালো করে দেখতে গিয়ে সেন্টার টেবিলটা নড়ে গেল। একটা বই পড়ে গেল। আর ঠিক তখনই—আঃ! কী সৌভাগ্য আমার! ভদ্রলোক কাগজখানি মুখের সামনে থেকে সরালেন। অমনি তার শ্রীচরণের মতো শ্ৰীমুখখানিও দেখতে পেলাম। ছুঁচলো মুখ। মাথাটা মুখের তুলনায় বড়ো। অনেকটা নারকেলের মতো। রুক্ষু চুলগুলো সেই মাথার ওপর ফেঁপে ফুলে উঠেছে। কিন্তু সরু গোপজোড়ার ভারী বাহার!

এও সহ্য করা যায়—কিন্তু এই রাত্তিরে কেউ যে কালো সানগ্লাস পরে থাকতে পারে তা যেন ভাবাই যায় না।

যাই হোক, ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। তার গলায় যে রুদ্রাক্ষের মালা ছিল এটা এতক্ষণ নজরে আসেনি। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর সামনে যে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন, সেদিকে লক্ষ্যমাত্র না করে ম্যাগাজিনের তলা থেকে খুলিটা নিয়ে বুলুর সেই আলমারিতে রেখে এলেন। যেন তিনি খুলিটা ভালো করে দেখতে নিয়েছিলেন, দেখার পর রেখে দিলেন আর কি।

বুলু কি আলমারিতে চাবি লাগিয়ে যায়নি? নাকি ওটা খোলাই থাকে?

জানি না।

ভদ্রলোক আবার নিজের জায়গায় গিয়ে মুখের ওপর কাগজ আড়াল করে বসলেন।

আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। জিগ্যেস করলাম, বুলু কখন আসবে বলতে পারেন?

উত্তরে একটা গম্ভীর স্বর গলার মধ্যে ঘড় ঘড় করে উঠল, মিনিট তেরোর মধ্যে।

ও বাবা! ইনি যে আবার মিনিট-সেকেন্ড ধরে কথা বলেন! দশ মিনিটও নয়, পনেরো মিনিটও নয়, একেবারে তেরো মিনিট!

জিগ্যেস করলাম, ওর সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছে?

না।

দেখা হয়নি, বুলু কোথায় গেছে তাও বোধহয় জানেন না। অথচ তিনি বলতে পারেন—তেরো মিনিট পরে আসবে!

কত রকমের স্ক্রু-ঢিলে মানুষই না আছে!

একটু পরে উনিই আবার কথা বললেন, হ্যাঁ, আর আট মিনিটের মধ্যেই ওর এসে পড়া উচিত যদি না কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়।

অ্যাকসিডেন্ট !

হ্যাঁ। মানে দুর্ঘটনা।

আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনি অ্যাকসিডেন্টের ভয় পাচ্ছেন কেন?

উনি তেমনি করেই উত্তর দিলেন, অ্যাকসিডেন্টকে ও ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে এনেছে।

কিন্তু বুঝতে না পারলেও রীণার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে নাকি বাস চাপা পড়ছিল।

এমনি সময়ে কলিংবেল বাজল। তারপর আধ মিনিটের মধ্যে বুলু হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল।— ও মা, কাকু! কতক্ষণ এসেছেন?

আমি উত্তর দেবার আগেই ভদ্রলোক হঠাৎই উঠে পড়লেন।

বুলু বললে, এ কি মামা, এখুনি উঠছেন?

হ্যাঁ। তুমি একটু শুনে যেও।

বলে সামান্যতম ভদ্রতাটুকুও না দেখিয়ে প্রায় আমার গায়ে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলেন।

বুলু ওকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল। মুখটা থমথম করছে। একটু চুপ করে থেকে বলল, উনি হঠাৎ অমন করে চলে গেলেন কেন বুঝলাম না। আপনার সঙ্গে বোধহয় ভালো করে কথাও বলেননি?

আমি একটু হাসলাম।

যাবার সময়ে আমাকে বললেন কি জানেন? বললেন, হয় ঐ খুলিটা এ ঘর থেকে সরাও, নয় যার-তার এ ঘরে ঢোকা বন্ধ করো। কথার মানে বুঝেছেন তো কাকু?

আমি আবার শুধু হাসলাম।

এই হচ্ছে নাকি বুলুর দু-নম্বর মজার জিনিস, বুলুর নতুন পাতানো মামা!

মামাটির সঙ্গে বুলুর আলাপ হয় নেপালের কাঠমাণ্ডুর একটা হোটেলে। তিনি বাঙালি। কলকাতাতেও যেমন তাঁর একটা আস্তানা আছে তেমনি আছে কাঠমাণ্ডুতেও। কিন্তু কাঠমাণ্ডুতে কোথায় যে পাকাপাকিভাবে থাকেন, কি করেন তা কেউ জানে না। মাঝে মাঝে এই হোটেলে তার দেখা পাওয়া যায়। এখানে তার পরিচয় একজন জ্যোতিষী বলে। মুখ দেখেই তিনি ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান বলে দিতে পারেন।

এই সূত্রেই বুলুর সঙ্গে তার আলাপ। হোটেলের সবাই ভিড় করে আসে তার ঘরে। শুধু বুলুই যায় না। সে এসব মোটে বিশ্বাস করে না। কিন্তু বুলু না গেলে কি হবে—ভদ্রলোক নিজেই একদিন ডাকলেন—ও মামণি! শোনো শোনো।

অগত্যা বুলুকে ঢুকতে হয়েছিল ওঁর ঘরে।

সবাই আসে, শুধু তুমিই আস না।

বুলু হেসে বলেছিল, আমি ওসব বিশ্বাস করি না।

ভদ্রলোক একটু হেসেছিলেন।

সেদিন ঐ পর্যন্ত ।

এরপর একদিন ভদ্রলোক বুলুকে একেবারে তাজ্জব করে দিলেন যখন বললেন, তোমার বাবার জন্যে কিছু ভেব না। তিনি ভালো আছেন। এই মাসের শেষেই তিনি ফিরে আসছেন।

বুলুর বাবা লিবিয়াতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। অবাক কাণ্ড—নেপালে আসার ঠিক আগের দিনই বুলুরা চিঠি পেয়েছিল—তিনি ফিরছেন।

এত বড়ো ভবিষ্যৎবাণীর পর আর কি ঠিক থাকা যায়? বরফ গলল। বুলু দারুণ বিশ্বাসী হয়ে গেল। ভদ্রলোককে ‘মামা’ বলে ডাকতে লাগল।

কিন্তু অবাক হবার ব্যাপার তখনো বাকি ছিল।

নেপাল থেকে ফেরার আগের দিন।

সন্ধের পর বুলুরা দক্ষিণাকালী দেখে হোটেলে ফিরল। দক্ষিণাকালী মন্দির কাঠমাণ্ডু থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে। অনেক পাহাড়, খাদ পেরিয়ে তবে যেতে হয়। মন্দিরটা একটা পাহাড়ের নীচে। নামতে হয় অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে। ঐরকম পরিবেশেই বুঝি কালীকে মানায়। প্রকৃতির কোলে নিস্তব্ধ, নিঝুম পরিবেশটি।

যাই হোক, বুলু ফিরেই তার এই নতুন মামাটির সঙ্গে দেখা করল। হাসতে হাসতে ব্যাগ খুলে কাগজে মোড়া একটা জিনিস বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, দেখুন তো মামা, জিনিসটা কেমন হল?

জিনিস দেখে তো মামা হতভম্ব! এটা তুমি কোথায় পেলে?

বুলু বলল, একজন পাহাড়ির কাছ থেকে কিনলাম দক্ষিণাকালীর মন্দিরের কাছে।

মামা অনেকক্ষণ ধরে সেই ছোট্ট খুলিটা পরীক্ষা করে দেখলেন। তারপর বললেন, এ যে বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। এ নিয়ে তুমি কি করবে মা?

বুলু তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে খুলিটা নিয়ে বলল, আলমারিতে সাজিয়ে রাখব।

মামা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ বুলুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, কাজটা কি ভালো হবে? ও যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেওয়াই উচিত।

এই পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর বললেন, আমি শিগগিরই ওখানে যাব। ইচ্ছে করলে আমায় দিতে পার। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেব। দামটা না হয় এখুনি তোমায় দিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু বুলু রাজি হয়নি।

তখন উনি বললেন, আমার কথা তোমার মাকে বোলো। তিনি কী বলেন আমায় জানিও।

বুলু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই জিগ্যেস করল—কেন? এটা যদি রাখি তা হলে কি হবে?

বিপদ অনিবার্য। কেন? আজ ওটা কেনার পর তোমার কি কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি?

এবার বুলুর মুখ শুকিয়ে গেল। মনে পড়ল দক্ষিণাকালী দেখতে যাবার সময়ে তিনতলা সমান উঁচু সিঁড়ি থেকে পা স্লিপ করে খাদে পড়ে যাচ্ছিল! খুব বেঁচে গেছে।

এই বিচিত্র মাথাটির সম্বন্ধে বুলু আগে কিছু খবর পেয়েছিল কাঠমাণ্ডু থেকে চলে আসার দিন হোটেলের নেপালি চাকরটির কাছ থেকে। তাকে খাবার সময়ে বখশিস দিতে কথায় কথায় ও হিন্দিতে জানায় যে ঐ লোকটি ভয়ঙ্কর দেবতা আছেন। তিনি নাকি নেপালের জাগ্রত দেবতা কালভৈরবের সাধক। কালভৈরব হচ্ছেন মৃত্যুর দেবতা। বিকট চেহারা। কুচকুচে কালো রঙ। তার গলায় মুণ্ডমালা— বীভৎস মুখের হায়ের মধ্যে দিয়ে তার হিংস্র জন্তুর মতো ধারালো দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

নেপালিটা জানাল, ঐ দেবতাকে খুশি করে ইনি প্রচণ্ড ক্ষমতা পেয়েছেন। ইচ্ছে করলেই যে কোনো লোকের ক্ষতি করে দিতে পারেন। ভয়ে হোটেলের ম্যানেজার ওঁর কাছ থেকে একটি টাকাও নেন না। উপরন্তু খাতির করেন।

এই হল বুলুর মামার পরিচয়। বুলুরা তো কলকাতা চলে এল। তারপর হঠাৎই একদিন সন্ধেবেলা সেই মামা বুলুদের বাড়ি এসে হাজির।

জিগ্যেস করলাম, ঠিকানা দিয়েছিলে?

বুলু একটু ভেবে বলল, ঠিক মনে নেই। নিশ্চয় দিয়েছিলাম। নইলে উনি এলেন কি করে?

তারপর থেকে প্রায় সপ্তাহে দুদিন করে আসেন। গল্প করেন, চলে যান।

কোথায় যান?

ঠাকুরপুকুরের কাছে কবরডাঙা বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে ওঁদের পুরোনো বাড়ি। কলকাতায় এলে একাই থাকেন। সবই কেমন রহস্যময়। বলি বটে, এই মামাটি মজার জিনিস। কিন্তু সত্যি বলছি কাকু, মাঝে মাঝে কেমন ভয়ও করে। লোকটার কাছ থেকে রেহাই পেলে বাঁচি ।

খুলিটার কথা উনি জিগ্যেস করেন?

বুলু মাথা নাড়ল।—না। এখানে এসে পর্যন্ত খুলির কথা বলেননি।

এই পর্যন্ত বলে বুলু ভুল শুধরে বললে—হ্যাঁ, একদিনই বলেছিলেন। সেই যে সাবধান করে দিয়েছিলেন।

আমি হাসলাম। বললাম, হ্যাঁ, পাছে আমি চুরি করে নিই!

বুলু লজ্জায় জিব কাটল –ইস্!

তবু সেদিন যে খুলিটা তিনি আলমারি থেকে বের করে আমার পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি ম্যাগাজিন চাপা দিয়ে রেখেছিলেন সে কথাটা বুলুকে আর বললাম না।

এই মামা লোকটিকে প্রথম দিন থেকেই আমার ভালো লাগেনি। শুধু অভদ্র বলেই নয়, লোকটি মতলববাজ। নেপালে না গেলেও জানি—এইরকম এক ধরনের তান্ত্রিক আছে যারা নিজের সিদ্ধির জন্যে সবরকম অপকর্ম করতে পারে। এ বাড়িতে তাঁর আসার উদ্দেশ্য অন্তত আমার কাছে পরিষ্কার! সেই সঙ্গে বুলুও যে কী মারাত্মক ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তাও আমার জানা। শুধু বুলুই নয়, আমিও লোকটির বিষনজরে পড়েছি। তাই বুলুর মনে আমাকে চোর বলে সন্দেহ ধরিয়ে দিতেও চেষ্টা করেছে। এরপর হয় তো আমার জীবনও বিপন্ন হতে পারে।

অপরাধ? অপরাধ—খুলি চুরি করার ওঁর চেষ্টা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে।

সে যাই হোক, বুলুকে এখন ঐ ভদ্রবেশী তান্ত্রিকের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

কিন্তু—কি করে? আমি যা ভাবছি তা যদি বুলুকে বলি তাহলে সে বিশ্বাস নাও করতে পারে। উল্টে আমার ওপর ধারণা খারাপ হবে।

আর যদি বিশ্বাস করেও, একজন ভদ্রলোককে কি সরাসরি বাড়ি আসতে বারণ করতে পারে? বারণ করলেই কি উনি শুনবেন? ঐ খুলিটা যে ওঁর চাইই।

দিন পনেরো পর।

অফিস থেকে সবে ফিরেছি। হঠাৎ বুলু এসে হাজির। তার উদভ্ৰান্ত ভাব দেখে চমকে উঠলাম।— কী হয়েছে?

আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল। আমরা কেউ ছিলাম না। আর সেই সময়ে—

কেন ? সেই বুড়ি কাজের লোকটি?

বলছি দাঁড়ান, আগে একটু বসি। ইতিমধ্যে রীণা, রীণার মাও এসে পড়েছেন।

রীণা, একটু জল দে তো!

রীণা তাড়াতাড়ি জল এনে দিল। জল খেয়ে রুমালে মুখ মুছে বুলু বলল, অন্য দিনের মতোই বুড়িটা দুপুরে ঘুমোচ্ছিল। আজ আবার দুপুরে এদিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। কাজেই আরামেই ঘুমোচ্ছিল। কখন থেকে যে কলিংবেলটা বেজে যাচ্ছিল তা সে শুনতে পায়নি। যখন শুনল ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলে দিল। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। তখন বুড়ি আবার গিয়ে শুল। একটু পরে আবার বেল বাজল, বুড়ি আবার উঠে দরজা খুলল। কিন্তু এবারও কাউকে দেখতে পেল না। এমনি করে তিন তিনবার। বুড়ি বুঝল এ নিশ্চয় কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ। তাই চারবারের বার বুড়ি রেগে রাস্তায় নেমে দুষ্টু ছেলে ধরবার জন্যে এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। কিন্তু কারো টিকিটুকুও দেখতে পেল না। তখন ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল।

এই পর্যন্ত বলে বুলু থামল।

বললাম, কিন্তু চোর এসেছিল কি করে বুঝলে? দুষ্টু ছেলের কাজও তো হতে পারে।

তা হতে পারে। তবু,

বুলু কি ভাবতে লাগল।

তারপর যেন আপন মনেই বলল, আমার কেমন ভালো ঠেকছে না। চোর এসেছিল বলেই আমার সন্দেহ। তাছাড়া—

বললাম, থামলে কেন ?

না, তেমন কিছু নয়, তবু বলছি, বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে দেখি চৌকাঠে জুতোর কাদা।

আমি চমকে উঠলাম। সে ভাব গোপন করে বললাম, কাদা আগে ছিল না ?

বুলু মনে করবার চেষ্টা করে বলল—তা হলে নিশ্চয় আমার চোখে পড়ত। তাছাড়া কাদা আসবে কোত্থেকে? বৃষ্টি তো হল দুপুরে।

রাইট! বলে বুলুর পিঠ চাপড়ালাম।

যাই হোক, কিছু চুরি যায়নি তো?

না! এইটুকুই রেহাই।

ঠিক জান কিছু চুরি যায়নি?

বুলু হেসে বলল, ঘরে ঢুকে এক নজর দেখে কিছু চুরি গেছে বলে তো মনে হল না।

চলো, এখনি তোমার বাড়ি যাব।

বলে তখনই গায়ে হাওয়াই শার্টটা চড়িয়ে বুলুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ওদের বাড়ি ঢুকেই চলে এলাম ওদের বাইরে-ঘরে। বুলুকে বললাম, তোমার আলমারিটা খোলো।

বুলু চাবি বের করে লাগাতে গেল কিন্তু তার দরকার ছিল না। আলমারিটা খোলাই ছিল। ভেতরে সেই খুলিটা নেই।

সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লাম।

বুলু ব্যাকুল হয়ে পিছু ডাকল—কোথায় যাচ্ছেন?

বললাম, কবরডাঙায় তোমার ঐ ভণ্ড মামার আস্তানায়।

ও প্রায় কেঁদে উঠল, না-না, এই সন্ধেবেলা যাবেন না।

কিন্তু আমার তখন জেদ, ওটা উদ্ধার করে লোকটাকে পুলিশে দিতেই হবে।

ঠাকুরপুকুরের এদিকটায় কখনো আসিনি। দু’ধারে মাঠ, কোথাও বা রীতিমতো জঙ্গল। কবরডাঙা জায়গাটা রীতিমতো গ্রাম। তবু রাস্তাটা পিচঢালা। বাস চলে। মাঝে মাঝে লরিও যায়। এখানে পুরোনো বাড়ি কি আছে জিগ্যেস করতেই একটা লোক মাঠের ওপর বিরাট দোতলা ভাঙা বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ভূতের বাড়ি তো?

হ্যাঁ, বলে মাঠে নেমে পড়লাম। লোকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দূর থেকে বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রেতপুরী। ইট খসে পড়ছে। আলসের মধ্যে দিয়ে উঠেছে অশ্বখের চারা। ঢুকে পড়লাম সেই বাড়িতে। অন্ধকার। চারিদিক থমথম করছে। তারই মধ্যে—হঠাৎ মনে হল যেন দুটো জ্বলজ্বলে চোখ! থমকে গেলাম।

না, একটা কুকুর। কুকুরটা আমায় দেখে পালাল। সামনেই সিঁড়ি। টর্চও সঙ্গে করে আনিনি। দেশলাই জ্বালতে জ্বালতে দোতলায় উঠে এলাম। একটা ঘর। বোধহয় একটি মাত্র ঘরেই দরজাজানলা আছে। ঢুকে পড়লাম। দড়িতে ঝুলছে একটা লুঙ্গি, একটা ফর্সা পাজামা, একটা পাঞ্জাবি। সামনে কালো কাপড় ঢাকা-ওটা কি?

ভালো করে দেখলাম। ওটা একটা তে-পায়া। চমকে উঠলাম। এইরকম তে-পায়াতেই তো প্রেতাত্মা নামানো হয়। মামা কি তা হলে—

কিন্তু, আসল জিনিসটি কোথায়? মামাই বা কোথায়?

আবার দেশলাই জ্বাললাম। লক্ষ্য পড়ল কুলুঙ্গিতে। একটি তামার পাত্রে সেই ছোট্ট মড়ার খুলিটি!

আমি মরিয়া হয়ে খুলিটা তুলে নিয়ে পকেটে পুরলাম। তারপর একছুটে নীচে। সামনেই সেই মাঠ। মাঠের পরেই পিচঢালা রাস্তা। পাছে দৌড়লে কারো নজরে পড়ি তাই জোরে হাঁটতে লাগলাম। নিশ্বাস বন্ধ করে হাঁটছি। চারিদিকে অন্ধকার—শুধু অন্ধকার!

হঠাৎ আমার মনে হল, এই নির্জন মাঠে আমি আর এক নই। কেউ যেন পিছনে রয়েছে। …হ্যাঁ, স্পষ্ট বুঝতে পারছি পিছনের মানুষটি এসে পড়েছে।…আমি দৌড়তে লাগলাম। কিন্তু পারলাম না। পিছনের লোকটা ঝাপিয়ে পড়ল আমার ওপর। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। সে অমনি আমাকে জাপটে ধরল। উঃ, কী কঠিন সে হাত দুটো। সে স্বচ্ছন্দে আমার পকেট থেকে খুলিটা বের করে নিল। তারপর আমার গলা টিপে ধরল।…মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আমি প্রাণপণ শক্তি প্রয়োগ করলাম। এক মুহুর্তের জন্যে ওর হাতটা ঢিলে হয়ে গেল। অমনি কোনোরকমে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ছুটলাম রাস্তার দিকে। সেও ছুটে আসছে আমার পিছনে।

রাস্তায় লরির হেডলাইট…তবু আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম রাস্তায়। লোকটাও সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিল। লরিটা দুরন্ত গতিতে বেরিয়ে গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম—নাঃ, আমি বেঁচে আছি। কিন্তু—রাস্তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে ওটা কি?

কিন্তু সেদিকে মন দেবার মতো অবস্থা তখন ছিল না। হাঁটতে লাগলাম ডায়মন্ডহারবার রোডের দিকে।

পরের দিন সকালে বুলুদের বাড়ি চা খেতে খেতে সমস্ত ঘটনা বললাম। কাগজেও ঐ অঞ্চলে লরিচাপা পড়ে একটি মৃত্যুর খবর বেরিয়েছে।

বুলু বলল, আপনি খুব বেঁচে গেছেন কাকু! ভাগ্যি খুলিটা তখন আপনার কাছে ছিল না।

আমি হেসে বললাম, আর লরির চাকার নীচে খুলিটারও সদব্যবহার হয়ে গেল।

বুলু একটু হাসল। তারপর বলল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, লোকটার যে বর্ণনা কাগজে রয়েছে তার সঙ্গে মামার চেহারা মেলে না।

আমি বললাম, তা জানি। ওটি মামার শাগরেদ। মামা কিন্তু রইলেন বহাল তবিয়তে। হয়তো আবার আসবেন।

বুলু শিউরে উঠল।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments