Wednesday, September 24, 2025
Homeইসলামিক গল্পখাব্বাব (রাঃ) এর নতুন আশা

খাব্বাব (রাঃ) এর নতুন আশা

খাব্বাব (রাঃ) এর নতুন আশা

বেলা শেষ হয়ে এসেছিল। চারদিকে ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। এতবড় বাজারটা প্রায় একেবারেই ফাঁকা। মাল-পত্তর কেনা-বেচা শেষ করে সবাই যে যার ঘরের পানে ছুটছে। শুধু এক কোণে ছিল একটা ছোটখাট ভীড়। উম্মে আনমার সেদিকে এগিয়ে চললেন।

“এ্যা, তোমরা এই এক রত্তি বাচ্চাটার ওপর একি জুলুম করছো?” উম্মে আনমার ক্রোধে ফেটে পড়লেন। “তোমরা কি একে মেরে ফেলবে? এতটুকুন বাচ্চার ওপর সবাই মিলে এভাবে কিল, চড়, লাথি, ঘুষি চালাচ্ছো কেন?” বলতে বলতে উম্মে আনমার আমের গোত্রের গোয়ার গুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কারো পিঠে ঘুষি চালালেন, কারো বুকে। কাউকে হাত ধরে দূরে হটিয়ে দিলেন।

আশ্চর্য! এক রত্তি রোগা-পটকা ছেলেটা একটু উহ আহ করছে না! মরার মত ধুলোয় পড়ে রয়েছে। কি জানি, দেহে প্রাণ আছে কিনা? উম্মে আনমার টেনে তুললেন ছেলেটাকে। তার গায়ের ধুলো ঝেড়ে দিতে লাগলেন। অবাক হলেন তার সহ্য শক্তি দেখে।

আমের গোত্রের এই দলটি তাদের সমস্ত মাল-পত্তর বিক্রি করে দিয়েছিল, এমনকি মালবাহী উটগুলোও। শুধু রয়ে গিয়েছিল এই বাচ্চা রোগা পটকা গোলামটি। এখন ব্যবসায়ের জিনিস-পত্তর কেনার জন্য তারা যাত্রা করবে ইরাকের পথে। তারা মনে করেছিল এতবড় হাটে যখন গোলামটি কেনার লোক পাওয়া গেল না তখন পথে কোনো আরব গোত্রের হাতে তাকে বেচে দিয়ে যাবে। কিন্তু সে তো মাটি কামড়ে পড়ে আছে। এক চুলও নড়ছে না এখান থেকে।

“মক্কায় না হয়ে যদি নজদে হতো তাহলে তোমাকে এক হাত দেখিয়ে দিতাম।” এতক্ষণে আমের দলপতি রাগত স্বরে বলল।

“দেখলাম তো, একটুখানি বাচ্চার ওপরই তোমাদের যতো বাহাদুরী।”

“এই অবাধ্য গোলামটির প্রতি এতো মায়া কেন বিবি সাহেবা? এতোই যদি দরদ, তাহলে একে কিনেই নাও না?”

“হ্যা, কিনবোই তো।”

দাম ঠিক হয়ে গেল। উম্মে আনমার বলতে গেলে দিরহামগুলো প্রায় ওদের গায়ের ওপর ছুঁড়ে মারলেন। লিকলিকে তালপাতার সেপাইটার হাত ধরে জোহরা গোত্রের মধ্য দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছিলেন উম্মে আনমার।

এ বাড়ি ওবাড়ি থেকে টিটকারীর আওয়াজ কানে আসছিলঃ “ও বিবি সাহেবা, এ লাশটাকে টেনে নিয়ে যাও কোথায়?”

“যেখানেই নিয়ে যাইনা কেন, তোমাদের তাতে কি? এ আমার খেদমত করবে। আমার বাচ্চার সাথে খেলবে।”

সকালে উঠে ঘরের কাজগুলো সেরে উম্মে আনমার বের হলেন বাইরের কাজে। বিকেলে বাসায় ফিরে এসে দেখেন বাচ্চা দুটো খেলার মধ্যে ডুবে আছে। বাচ্চাদের খাইয়ে দাইয়ে কাছে নিয়ে গল্প করতে বসলেন। গোলামটির মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার নামটা কি বলতো দেখি বাবা?”

“খাব্বাব।”

“তোমার আব্বার নাম।”

“আরাত।”

“আচ্ছা, তোমার মায়ের নাম।”

বাচ্চার মুখ দিয়ে আর কোনো জবাব বের হল না। সে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। উম্মে আনমার তার চোখের পানি মুছে দিলেন। তাকে আদর করলেন। কাঁদতে কাঁদতে খাব্বাব যা বলল তার সার কথা হলঃ আমের গোত্রের লোকেরা একদিন ধোকা দিয়ে অতর্কিতে তাদের পল্লীতে আক্রমণ চালায়। তার আব্বা ছাড়া গোত্রের পুরুষেরা কেউ বাড়িতে ছিল না। তার আব্বা একাই ডাকাতদের সাথে লড়াই করেন। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ডাকাতরা তাঁকে কাবু করে ফেলে এবং স্ত্রী, ছেলেমেয়ের সামনে তাকে জবাই করে।

তার মাকে ও বোনকে অন্য গোত্রের হাতে বিক্রি করে। খাব্বাবের দুঃখের কাহিনী শুনে উম্মে আনমারের দু’চোখ পানিতে ভরে উঠল। উম্মে আনমার খাব্বারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তাকে আদর করলেন। তাকে নিজের ছেলের মত মানুষ করতে লাগলেন। একটু বয়স হলে তাকে লাগিয়ে দিলেন কামারের দোকানে কাজ শিখতে। উম্মে আনমারকে সে নিজের মায়ের মত মনে করতো।

সমবয়সী গোলামদের সাথে খাব্বাব কাজ করে কামারের দোকানে। বয়স বাড়ার সথে সাথে তার অনুভুতিও বাড়তে থাকে। তখন সে নিজেকে একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। গোলামীর জীবন তাকে বেশ পীড়া দিতে থাকে। প্রায়ই তার সমবয়সী গোলামরা নির্জনে বসে আড্ডা জমাতো। কথাবার্তার মধ্যে নিজেদের দুরবস্থার ছবিই তাদের চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠতো। রাগে, দুঃখে তারা কেঁদে ফেলতো। অনেক সময় কঠিন পণ করে বসতো। কিন্তু পরক্ষণেই আশেপাশের আরব পল্লীগুলোর গোলামদের দুরবস্থার কাহিনী তাদের মনে জাগিয়ে তুলতে অন্তহীন নিরাশা।

একদিন পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা। একথা সেকথা নানা কথা। এবারের কথাবার্তায় বন্ধুর মধ্যে নতুন একটা কিছু দেখতে পেল খাব্বাব। মনে হল তার এই বন্ধু নিরাশার সাগর পার হয়ে এসেছে। দুঃখ ও হাতাশার কোন চিহ্নই তার মুখে নেই। আশা আর আনন্দ যেন বারে বারে তার কথার মাঝখানে ছলকে পড়ছে। ব্যাপার কি? হঠাৎ এমন পরিবর্তন। একটু অবাকই হলো খাব্বাব। বেশীক্ষণ নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারল না সে।

এক সময় জিজ্ঞেস করেই বসলোঃ “ব্যাপারখানা কি, একটু খুলেই বল দেখি। আজ তোমার মধ্যে যেন একটা নতুন জিনিস দেখছি। অন্য বন্ধুদের সাথে আলাপ আলোচনায় এ জিনিসটি চোখে পড়েছে বলে মনে হয়নিতো কোনো দিন। তুমি কি নতুন কিছুর সন্ধান পেয়েছো?”

বন্ধুটি সাধারণত যেভাবে তার কথার জবাব দিয়ে থাকে সেভাবে না বলে একটু অন্যভাবে বললঃ “পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো, তোমার প্রতিপালক অতি মহান! তিনি কলমের সহায্যে শিখিয়েছেন। শিখিয়েছেন মানুষকে যা সে কোন দিন জানত না। কিন্তু মানুষ সীমা লংঘন করে কারণ সে নিজেকে মনে করে অভাব মুক্ত। কিন্তু অবশেষে তোমার প্রতিপালকের কাছে অবশ্যি ফিরে যেতে হবে।”

বন্ধু বলে চলছিল আর খাব্বারের সমস্ত মন দুলে উঠছিল। মনে হচ্ছিল চারদিকে সমস্ত প্রকৃতিও যেন ঝড়ের আবেগে লুটোপুটি খাচ্ছে। সে আর দাঁড়াতে পারছিল না। তার শরীর দারুণভাবে কাঁপছে। তার দাঁতে দাঁত লেগে খটখট আওয়াজ হচ্ছে। মনে হল বুঝি সে এখুনি পড়ে যাবে। বন্ধু তাকে এ অবস্থার মধ্যে ছেড়ে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যে তার শরীরের কাঁপুনি থেমে গেল। জ্ঞান ও অনুভূতি সজাগ হল। তখন সে বন্ধুকে বলল। “কি বললে? কি পড়লে তুমি? আমি তো কিছুই শুনতে পেলাম না। আমার যেন কেমন হয়ে গেল। আবার বল! আবার বল!” খাব্বাবের অনুরোধে বন্ধু বার বার তাকে পড়ে শোনাতে লাগল। খাব্বাব যেন এক নতুন স্বাদ পেল। তার সমস্ত মন-প্রাণ নেচে উঠল। বন্ধুর বলা কথাগুলো বার বার আওড়াতে থাকল সেঃ “কিন্তু মানুষ সীমা লংঘন করে- কারণ সে নিজেকে মনে করে অভাবমুক্ত। কিন্তু অবশেষে তোমার প্রতিপালকের কাছে অবশ্যি ফিরে যেতে হবে।”

“বন্ধু, তুমি একথা কোথায় পেলে? এগুলো তোমার কথা বলে তো মনে হচ্ছে না। বল, বল, কোথা থেকে এসব কথা শুনলে? আমি কি শুনতে পারি না সেখান থেকে?”

“হ্যা, তুমিও শুনতে পার। কোন বাধা নেই। এ কথা, এ বাণী আমার নয়, আসমান থেকে এসেছে। তাহলে চল আমার সাথে আল আমীনের কাছে। তিনিই এসব কথা সবাইকে শুনাচ্ছেন। আমাদের সব দুঃখ ঘুচে যাবে। আমরা সবাই একমাত্র আল্লাহর গোলাম। সবাই ভাই ভাই। সবাই সমান। নিরাশার মেঘ তোমার আকাশ থেকেও কেটে যাবে। মুক্তি পাবে। মানুষের গোলামী থেকে। তবে চল আমার সাথে।”

দু’ বন্ধু এগিয়ে চলল। চলল মহানবীর কাছে। সামনে নতুন দিন। নতুন আশা নতুন আলো। খাব্বাবের চোখে নতুন স্বপ্ন।

GolpoKotha
GolpoKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments