Friday, June 20, 2025
Homeমজার গল্পনীল আলো – তারাপদ রায়

নীল আলো – তারাপদ রায়

নীল আলো – তারাপদ রায়

নিলামে একটা রঙিন টিভি কিনেছিলেন প্রেমতোষ। নতুনের দামের প্রায় অর্ধেক দামে। অনেকদিনই একটা রঙিন সেটের শখ ছিল প্রেমতোষের। খোঁজ নিয়ে দেখেছিলেন পাঁচ অঙ্কের টাকা একটা নতুন সেটের দাম।

টাকার পরিমাণ দেখে দমে গিয়েছিলেন প্রেমতোষ। প্রেমতোষের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ তা বলা যাবে না। ফল সংরক্ষণের একটি কেন্দ্রীয় সরকারি আন্ডারটেকিংয়ে ফিনান্স অফিসারের চাকরি করেন তিনি। তার কোম্পানি এখনও কোনও রকম ফল সংরক্ষণের কাজে হাত দেয়নি। কিন্তু ভবিষ্যতে কী করা হবে তারই ছক কষার জন্য শ তিনেক লোক কাজ করে।

প্রেমতোষ মাইনে যা পান তাতে এক মাসের আয়ে একটা নতুন সেট টিভি কেনা চলে। কিন্তু প্রেমতোষ মিতব্যয়ী লোক। সব কিছুতে একটু সাশ্রয় করার চেষ্টা করেন। বাজারে ছোট আলু, ছোট পটল কেনেন। কেজি প্রতি পঞ্চাশ পয়সা কম লাগে বলে।

এরকম তো অনেকেই করে। কিন্তু প্রেমতোষের সাশ্রয় করার ধরনটা একটু অন্যরকম। একটা ছোট উদাহরণ দিই।

সকালবেলায় অফিস যাওয়ার আগে স্নান করার সময় তিনি দাড়ি কামান। দাড়ি কামানোর পরে সাবানের বুরুশ কিন্তু ধুয়ে ফেলেন না। বুরুশটা ধুয়ে ফেলেন ভাত খেয়ে উঠে আঁচানোর সময়। এতে হাত ধোয়ার জন্যে আর আলাদা করে সাবান লাগে না, বুরুশের সাবানেই কাজটা হয়ে যায়, বুরুশটাও ধোয়া হয়ে যায়। তা ছাড়া দাড়ি কামানোর সাবানের একটা সৌরভ আছে, তাতে হাতে একটা সুগন্ধ লেগে থাকে।

রঙিন টিভি কেনার ব্যাপারে একটা মওকা পেয়ে গিয়েছিলেন প্রেমতোষ। হঠাৎ রবিবারের ইংরেজি কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল, একটি গুজরাতি পরিবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাদের বাড়ির জিনিসপত্র ফার্নিচার, টিভি, ফ্রিজ, এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদি তারা সেই রবিবার সকালেই নিলামে বেচে দেবে।

সাহেব পাড়ায় মিডলটন স্ট্রিটের ঠিকানা। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বাস থেকে নেমে খুঁজতে খুঁজতে ঠিকানাটায় পৌঁছে ছিলেন প্রেমতোষ চৌধুরি।

টিভিটা চালু অবস্থাতেই ছিল। হাঁকাহাঁকি করে যে দাম উঠল সেটাও আয়ত্তের মধ্যে। নগদ দাম চুকিয়ে টিভিটা একটা ট্যাকসি করে বাড়ি নিয়ে এলেন তিনি।

বাড়িতে প্রেমতোষবাবু তাঁর এক গোলমেলে দাদার সঙ্গে থাকেন। দুই ব্যাচেলার সংসার দেখাশোনা করে একটি বোবা কাজের মেয়ে। ঠিক মেয়ে বলা চলে না, মধ্যবয়সিনী। প্রেমতোষবাবুর সুবিধে সে বোবা বলে কম মাইনে দিলেও কিছু বলতে পারে না। বোবা মেয়েটির নাম দামিনী। কিন্তু যে কানে শুনতে পায় না, তার নাম দিয়ে আর কী হবে।

দামিনী কিন্তু সেয়ানা আছে। সে ভালই জানে তার কত মাইনে হওয়া উচিত। কিন্তু সে কম মাইনে নেয় এই আশায় যে ওই দুই ভাইয়ের মধ্যে যেকোনও একজন তাকে কখনও বিয়ে করবে। দামিনী সব সময়ে লজ্জানা, ব্ৰীড়ানতা ভঙ্গিতে থাকে। মাঝে মাঝেই জিব কাটে।

দামিনীর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। তার সঙ্গে ঝগড়া করে না পেরে আগের স্বামী পালিয়ে যায়। প্রেমতোষ এ খবর শোনার পর মাথা ঘামিয়ে ছিলেন কী করে বোবা বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করত লোকটা, আর সেই ঝগড়ায় হেরে যেত। কিন্তু পাশের বাড়ির যে বুড়ি দাসী দামিনীকে দেয়, সে প্রথমেই সাবধান করে দিয়েছিল, দামিনী এমনিতে খুব ভাল, কিন্তু বড় ঝগড়াটে।

প্রেমতোষবাবুর দাদা মহীতোষবাবু চিরকাল অপ্রকৃতিস্থ ছিলেন না। তিনি একটি পাঁচতারা হোটেলের হেলথ ক্লাবের ব্যায়াম নির্দেশক। সেখানে বিভিন্ন বয়সি স্থূলদেহী পুরুষ এবং মহিলার পরিচর্যা করে করে এখন সব কিছুই বড় বড়, মোটা মোটা দেখেন। দানাদার দেখলে ভাবেন রাজভোগ, পাতে ছোট এক টুকরো মাছ দিলে বলেন এত বড় মাছ। অবশ্য প্রেমতোষবাবুর ধারণা অতিরিক্ত শীর্ষাসন করে তার দাদার এই অবস্থা। উলটো দিক থেকে দেখে দেখে দৃষ্টিভঙ্গিটাই পালটিয়ে গেছে।

সে যা হোক, প্রেমতোষ তো পুরনো টিভি সেটটা কিনে বাড়ি নিয়ে এলেন। মহীতোষ জিনিসটা দেখে খুব বিরক্ত বোধ করলেন, মুখে শুধু বললেন, আস্ত একটা সিনেমা বাসায় নিয়ে এলি।

মহীতোষ টিভির ঘরে একদম এলেন না। দামিনী মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে। উদ্দাম নাচের কিংবা ঘনিষ্ঠ প্রেমের দৃশ্যে জিব কেটে পালিয়ে যায়।

দু-চারদিন টিভিটা মোটামুটি চলেছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন চলতে চলতে ফুস করে নিবে গেল।

ইতিমধ্যে প্রেমতোষবাবু বুঝে ফেলেছিলেন, ওই গুজরাতি পরিবারের বিদেশ যাত্রার ব্যাপারটা পুরো ভুয়ো। ওটা একটা কায়দার বিজ্ঞাপন। প্রত্যেক সপ্তাহেই ইংরেজি কাগজের নির্দিষ্ট কলমে ওই একই মিডলটন স্ট্রিটের ঠিকানা দিয়ে একইরকম জিনিসের বিজ্ঞাপন বেরোয়। কখনও লেখা থাকে গুজরাতি পরিবার আমেরিকা যাচ্ছে, কখনও থাকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে।

নিতান্ত কৌতূহলবশত পরের এক রবিবার প্রেমতোষবাবু ওই নিলামের ওখানে আরেকবার গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখেছিলেন, আগের বার যারা ডাকাডাকি করে নিলাম হাঁকছিল এবারেও প্রায় তারাই তিন হাজার-সাড়ে তিন-পৌনে চার হাজার-চার এই রকম ডেকে ডেকে জিনিসের দাম তুলে দিচ্ছে। তার মানে, এরাও সাজানো মাইনে করা লোক। বিজ্ঞাপন দেখে অনভিজ্ঞ দু-চারজন উটকো। খদ্দের আসে, তাদের ঠকানোর কারবার।

টিভি খারাপ হয়ে যেতে প্রেমতোষ গড়িয়াহাট মোড়ের এক টিভি মিস্ত্রির খোঁজ করলেন। দোকানদার অবশ্য মিস্ত্রি কথাটা পছন্দ করলেন না, তিনি বললেন, মেকানিক ডাকতে গেলে একশো টাকা জমা দিয়ে নাম বুক করতে হবে। ঠিকানা দেখে মেকানিক সময় মতো চলে যাবেন। তারপর তিনি দেখে এসে রিপোর্ট করবেন।

প্রেমতোষ বললেন, উনি কখন যাবেন জানতে পারলে সুবিধে হয়। বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই, তা হলে আমি তখন বাসায় থাকব। দোকানদার প্রেমতোষবাবুর ঠিকানা জানতে চাইলেন, খাতাপত্র দেখে বললেন, আপনার দিকে মিস্টার পাল রাউন্ডে যান বৃহস্পতিবার, তার মানে পরশুদিন। দোকানদার আবার খাতা দেখে কী একটা সূক্ষ্ম হিসেব করে বললেন, পরশুদিন তিনটে, সাড়ে তিনটে নাগাদ পৌঁছে যাবে।

প্রেমতোষবাবু অনুনয় করলেন, শনি-রবিবার সম্ভব হবে না? ওই দুদিন আমার ছুটি থাকে।

দোকানদার বললেন, অসম্ভব। শনিবার বন্ডেল, রবিবার গোলপার্ক।

অগত্যা প্রেমতোষবাবু বহুদিন পরে বৃহস্পতিবার একটা হাফ ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে দুপুরে বাসায় ফিরে এসে বসে রইলেন।

তিনটে বা সাড়ে তিনটে নয়। মিঃ পাল এলেন পাঁচটা পার হয়ে। চোখে সানগ্লাস, গায়ে স্পোর্টস গেঞ্জি, হাতে ভি আই পি সুটকেস।

মি. পাল কলিংবেল বাজিয়ে পরপর চারটে সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন করলেন। প্রথমেই জানতে চাইলেন, আপনিই প্রেমতোষ চৌধুরি?

প্রেমতোষবাবু দরজা খুলে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ।

টিভি খারাপ হয়েছে?

প্রেমতোষবাবু আবার বললেন, হ্যাঁ।

বাড়িতে কুকুর নেই তো?

প্রেমতোষবাবু জানালেন, না।

জুতো খুলতে হবে নাকি?

প্রেমতোষবাবু বললেন, দরকার নেই।

মি. পাল জুতো মশমশ করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে টিভির সামনে একটি সোফায় বসে একটা কিং সাইজ সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেটটা প্রেমতোষবাবুর দিকে এগিয়ে বললেন, চলবে নাকি?

প্রেমতোষবাবু করজোড়ে সিগারেট প্রত্যাখ্যান করলেন।

সিগারেট টানতে টানতে গভীর অভিনিবেশ সহকারে মি. পাল টিভি সেটটাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ দেখার পরে জিজ্ঞাসা করলেন, এ মডেলের মাল কোথায় পেলেন মশায়? এ যে মিলিটারি ডিসপোজালের পুরনো চোরাই মাল।

প্রেমতোষবাবু সংবাদটা শুনে একটু বিচলিত হলেন। তবে বুঝতে দিলেন না, বললেন, নিলামে কিনেছি।

দেখা গেল মি. পাল বহুদর্শী লোক। অনেক কিছু খোঁজখবর রাখেন। নিলামের কথা শুনে তিনি বললেন, মিডলটন স্ট্রিটের নিলাম তো? গুজরাতি হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ, মি. অ্যান্ড মিসেস দেশাই, সব বেচে দিয়ে বড় মেয়ে কানাডায় ডাক্তার, তার কাছে চলে যাচ্ছেন, তাই তো৷ ছিঃ ছিঃ! কালীঘাটের ভোলা হালদার হয়েছে মি. দেশাই, আর রিপন স্ট্রিটের রেহানা হয়েছে মিসেস দেশাই। ছিঃ! ছিঃ! জাত ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চিটিং করছে!

প্রেমতোষবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন।

মি. পাল সোফা থেকে উঠে ভি আই পি সুটকেস খুলে যন্ত্রপাতি বার করে টিভির বাক্সটা অবলীলাক্রমে খুলে ফেললেন। পিছনের ঢাকনাটা উপুড় করে দিয়ে তার মধ্যে ভিতরের ছোট বড় নানারকম জটিল যন্ত্রাংশ খুলে খুলে রাখতে লাগলেন। তারপর হাত-পা হঠাৎ ছেড়ে গেলে লোকে যেভাবে কী পরিমাণ ক্ষত হয়েছে সেটা অনুধাবন করার চেষ্টা করে সেটের ভেতরটা একটু ঘাড় নামিয়ে দেখলেন, অবশেষে নিদান হাঁকলেন, একেবারে শেষ অবস্থা, টিউবটা একেবারে গেছে।

এবার মি. পাল উঠলেন। নিজের সুটকেসটা একটু গুছিয়ে নিলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, চোখের কালো চশমাটা যেটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে জামার ওপর পকেটে রেখেছিলেন সেটাকে সুটকেসের মধ্যে ভরে নিলেন। ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরিয়ে প্রেমতোষকে বললেন, সোমবার একবার যাবেন, এস্টিমেট পেয়ে যাবেন। টিভিটা যন্ত্রপাতি খোলা অবস্থায় সেই রকম পড়ে রইল।

তবে এস্টিমেটটা সোমবার পাওয়া গেল। হাজার চারেক টাকা লাগবে। পিকচার টিউব থেকে নাট বলটু সবই মেরামত করতে হবে কিংবা পুরোপুরি বদলাতে হবে।

এত সহজে চার হাজার টাকা খরচ করবার লোক প্রেমতোষ নন। দোকান থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে এসে দামি এস্টিমেটটা ছিঁড়ে ফেলে ছিলেন। ফুটপাথের পাশের একটা কাঠের বেঞ্চিতে লুঙ্গি ও হাতকাটা কালো গেঞ্জি পরে মি. পাল বিড়ি সহযোগে ভাড়ে চা খাচ্ছিলেন, এস্টিমেটটা ছিঁড়ে ফেলতে দেখে তিনি কটমট করে তাকালেন প্রেমতোষের দিকে।

টিভির শোক সামলে উঠতে পারছিলেন না প্রেমতোষ। বাড়ি ঢুকলেই বসার ঘরে নাড়িভুড়ি বার করা সেটটা চোখে পড়ে। এদিকে এত খরচ করাও বিশেষ করে জোচ্চোরের গছানো রদ্দি টিভির জন্যে, প্রেমতোষবাবুর মনঃপূত নয়।

কিন্তু হঠাৎই সমস্যাটার আংশিক সুরাহা হয়ে গেল। প্রেমতোষের অফিসের একটা কারখানা বানানো হচ্ছে, কলকাতার কাছেই শহরতলিতে। ফলের রস তৈরি করার কারখানা। প্রেমতোষ গিয়েছিলেন কারখানা নির্মাণের ব্যয়ের সরেজমিন তত্ত্বাবধান করতে।

কারখানা তৈরির টেন্ডার পেয়েছিলেন রামকিষেণ সিং নামে এক পাঞ্জাবি কন্ট্রাক্টর। একটু রোগা, একটু বেঁটে, সর্দারজি হিসেবে একটু বেমানান, কিন্তু দাড়ি আর জবরদস্ত পাগড়ি মাথায় ভদ্রলোক। একেবারে চোস্ত শিখ।

দু-চারদিন কাজের পর সর্দারজির সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল প্রেমতোষবাবুর। সেই সময়ে। একটা চমকপ্রদ তথ্য অবগত হলেন তিনি।

সর্দারজি মোটেই পাঞ্জাবি নন। তিনি ষোলো আনা বাঙালি। তার নাম রামকিষেণ সিং নয়, রামকৃষ্ণ সিংহ। হুগলি জেলার লোক। গুরুমুখী ভাষা মোটেই জানেন না, খুচখাচ হিন্দি আর ইংরেজি ও বাংলা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন।

রামকৃষ্ণবাবুর কাছেই প্রেমতোষবাবু জানতে পারলেন এসব ব্যবসায় বাঙালিদের কদর খুব কম, এমনকী বাঙালিরাও কদর করে না, বরং পারলে শত্রুতা করে, শিখ কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে সেটা সাহস পায় না। তা ছাড়া বাংলা জানা অবাঙালিদের এখন খুব রমরমা। সেই সুযোগটাই রামকৃষ্ণবাবু সদ্ব্যবহার করেছেন।

কাজের জায়গা থেকে বাড়ি ফেরার সময় কোনও কোনও দিন রামকৃষ্ণ প্রেমতোষকে বাড়িতে নামিয়ে দেন। ভদ্রতার খাতিরে একদিন প্রেমতোষ রামকৃষ্ণকে বললেন, একটু বসে এক কাপ চা খেয়ে যান।

সদর দরজায় প্রেমতোষ বেল টিপলেন। কোনও বেল বাজার শব্দ হল না, কিন্তু দামিনী এসে দরজা খুলে দিল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রেমতোষের দিকে রামকৃষ্ণ তাকালে তিনি বললেন, আমাদের কাজের মেয়ে। কানে শুনতে পায় না। তাই সুইচ টিপলে বেল বাজে না, আলো জ্বলে ওঠে, সেটা দেখে ও এসে দরজা খুলে দেয়।

বাইরের ঘরের টেবিলের সঙ্গেও একটা সুইচ লাগানো আছে। সোফায় বসে প্রেমতোষ পরপর তিনবার সুইচ টিপলেন, তার মানে হল চা।

রামকৃষ্ণবাবু অবাক হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন, এমন সময় তার চোখে পড়ল অসংবৃত টিভি সেটটির ওপর, সেদিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? প্রেমতোষ যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত করে টিভি-দুর্বিপাক আনুপূর্বিক ব্যক্ত করলেন।

বেশ মনোযোগ দিয়ে সব শুনে রামকৃষ্ণ বললেন, আমি আপনার সেটটা একটু চেষ্টা করে দেখব নাকি?

প্রেমতোষ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সে কী? আপনি টিভি সারাতে পারেন নাকি?

রামকৃষ্ণ বললেন, হুগলি কলেজ থেকে বি. এসসি ফেল করে প্রথমে টিভি সারানোর লাইনে গিয়েছিলাম। তখন তো সদ্য সাদা-কালো টিভির জমানা শুরু হয়েছে। বড় ফোর টোয়েনটি লাইন, লোক ঠকানোর ব্যবসা। ঘেন্নায় ছেড়ে দিলাম।

প্রেমতোষবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তারপর?

রামকৃষ্ণ সিংহ বললেন, তারপর থেকে সাত ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছি। অবশেষে আপনাদের ঘাটে এসে ভিড়েছি।

ইতিমধ্যে দামিনী চা নিয়ে এসেছে। আজ সে অধিকতরা লজ্জাশীলা, কপালে ঘোমটা টেনে দিয়েছে।

চা খেয়ে রামকৃষ্ণবাবু টিভিটা দেখতে উঠলেন। একটু দেখে বললেন, পুরনো জিনিস। তবে খুব একটা খারাপ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপর বললেন, এটা তো রঙিন টিভি, আমি শিখেছিলাম সাদা কালো টিভির কাজ। তবু দেখি একটু চেষ্টা করে।

প্রেমতোষবাবুর ব্যবহৃত একটা পুরনো ব্লেড, একটা তরকারি কাটা ছুরি, আর রান্নাঘরের সাঁড়াশি দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রামকৃষ্ণ সিংহ টিভি সেটটা প্রাণবন্ত করে তুললেন। শুধু একটা গোলমাল হল শব্দ-টব্দ সবই ঠিক আছে, ছবিও ঠিক আছে, কিন্তু রংটা এল না। তবে সাদা কালো নয়, ঝলমলে নীল রঙের ছবি এল।

দূরদর্শনে তখন হুহুক্কা হুহুয়া, হুহু, হুয়া এইরকম একটা মার-মার, কাট-কাট হিন্দি গান হচ্ছিল, কোনও এক বস্ত্র-কোম্পানি প্রণোদিত। ইতিপূর্বে প্রেমতোষবাবু তার হিসেবি মনোভাব নিয়ে ভেবেছেন এত কম জামাকাপড় পরা পাত্র-পাত্রীদের যদি বস্ত্র ব্যবসায়ীরা উপস্থাপন করেন, তা হলে তাঁদের ব্যবসা লাটে উঠবে, এ তো নিজের পায়ে নিজের কুড়ুল মারা।

আজ প্রেমতোষবাবু সংকোচবশত এ জাতীয় মন্তব্যের ধারে কাছে গেলেন না, বরং পুরুষ নর্তকেরা যখন গাছের আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে, হু-হুঁ হুয়াহু, হুয়াহু হুয়া-হুঁয়া করছিল, তিনি রামকৃষ্ণবাবুর দিকে তাকিয়ে খুবই অন্তরঙ্গভাবে বললেন, নীলবর্ণ শৃগাল কথা।

রামকৃষ্ণ সিংহ হাসলেন। কিন্তু তিনি সুরসিক লোক। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বললেন, টিভিটা এখন চলুক। এইভাবেই চলুক। আমি দু-চারদিনের মধ্যে একটা মিস্ত্রি পাঠিয়ে দেব। সে এসে সব ঠিকঠাক করে দেবে। ততদিন মনের আনন্দে যতক্ষণ ইচ্ছে ব্লু ফিল্ম দেখুন।

ঠিক এই সময়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে আজন্ম ব্রহ্মচারী মহীতোষবাবু নেমে আসছিলেন। বিকেলের এই সময়টায় তিনি ছাদে উঠে শীর্ষাসন করেন, অস্তগামী সূর্যকে নিজের পদদ্বয় দেখান।

আজ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় ছোট ভাইয়ের সঙ্গে এক অচেনা ভদ্রলোক দেখে এবং ব্লু ফিল্ম কথাটি শুনে তিনি বাইরের ঘরে উঁকি দিলেন। তখন আগের গান শেষ হয়ে নতুন জিনিস শুরু হয়েছে। এক দঙ্গল প্রায় উলঙ্গ তরুণী তাদের অঙ্গের গোলাকার প্রত্যঙ্গ সমূহের বহুরকম আবর্তন করে দুধ বনে যাবে, মালাই বনে যাবে, মাছ বনে যাবে, কাবাব বনে যাবে, ইত্যাদি নানা গোপন অভিপ্রায়ের কথা গানের সুরে জানাচ্ছে।

এই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে মহীতোষবাবু আঁতকিয়ে উঠে স্বগতোক্তি করলেন, ছিঃ! ছিঃ! এতবড় অনাচার। আমার বাড়িতে ব্লু ফিল্ম। গজগজ করতে করতে মহীতোষবাবু বেরিয়ে গেলেন, যদিও পৈতৃক বাড়ি, তার ধারণা তিনিই বড় ভাই বলে বাড়িটা তারই।

মহীতোষবাবু বেরিয়ে যাওয়ার মুখে রামকৃষ্ণবাবুর দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকে লোপট বলে অভিহিত করে গেলেন।

রামকৃষ্ণ বিস্মিত হয়ে প্রেমতোষের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে, প্রেমতোষ বললেন, আমার দাদা। তারপর নিজের মাথার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বোঝালেন যে মাথা খারাপ।

রামকৃষ্ণ আর দাঁড়ালেন না। তিনি পোড় খাওয়া লোক। বোবা, লজ্জাবতী পরিচারিকা, অপ্রকৃতিস্থ অগ্রজ–প্রেমতোষবাবুর বাড়িতে আর কী কী আছে সেটা জানার তার আর মোটেই আগ্রহ নেই।

এরপর সারা সন্ধ্যা চুটিয়ে দূরদর্শন উপভোগ করলেন প্রেমতোষবাবু। সংবাদ শুনলেন, মানে বার দশেক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বার দুয়েক মুখ্যমন্ত্রীর দেখা পাওয়া গেল। অন্যান্য ভাগ্যবান মন্ত্রীদেরও দেখতে পেলেন। শুনতে পেলেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের কিছু এলোমেলো সংবাদ। তারপর লংজাম্প, হাইজাম্প সহকারে জীবনমুখী সংগীত। বিশেষ বর্ণনা করে লাভ নেই, ভুক্তভোগী মাত্রেই এসব জানেন।

এদিকে রাত নটা বেজে গেছে। মহীতোষ এখনও বাড়ি ফেরেননি। প্রতিদিন রাত নটায় দুইভাই এক সঙ্গে বসে খান। আজ বাড়িতে অনাচার দেখে ব্যায়ামাচার্য ব্রহ্মচারী মহীতোষ পার্কে গিয়ে বসে আছেন।

প্রেমতোষ হাত দিয়ে নানারকম ইঙ্গিত করে দামিনীকে বুঝিয়ে তাকে পার্কে পাঠালেন দাদাকে ডেকে আনতে।

দামিনীকে দেখে উত্তেজিত হয়ে মহীতোষ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্লু ফিল্ম, ওই নীল ছবি বন্ধ করেছে প্রেম? দামিনী জিব কেটে, ঘোমটা টেনে ঠিক কী জবাব দিল সেটা বোঝা গেল না।

পার্কে মহীতোষবাবুর পাশেই কয়েকটি সমাজ সচেতন যুবক বসেছিল। তারা ব্লু ফিল্ম শুনে চঞ্চল হয়ে উঠল। তারা মহীতোষবাবুদের বাড়ি চেনে। পার্ক থেকে বেরিয়ে তারা সরাসরি সেখানে এসে বাইরের ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি দিল।

সেই অতর্কিত মুহূর্তে প্রেমতোষবাবুর টিভির ঘন নীল আলোয় দিল্লি দূরদর্শনের কেন্দ্রীয় সম্প্রচারে একটি অতি রোমান্টিক দক্ষিণী সিরিয়ালের প্রগাঢ় প্রেমের দৃশ্য প্রতিভাত হচ্ছিল। উদ্ভিন্ন যৌবনা নায়িকাকে সুনীল সাগরের সবুজ কিনারে শালপ্রাংশু মহাভুজ নায়ক সবলে আকর্ষণ করেছেন। নায়িকার সেকী ছটফটানি; লুঙ্গি পরিহিত, খালি গা নায়কের গোঁফের প্রান্তে বিজয়ীর হাসি।

সমাজসেবী যুবকেরা পলক মাত্র নীল দৃশ্যটি দেখে নিজেদের কর্তব্য স্থির করে ফেলল। তারা গলির পিছন দিকে ছুটল।

সেখানে গলির মোড়েই হাজরা ফাঁড়ি। সেই ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত দারোগা হাজারি হাজরা সাহেব। একটু সাবেকি জমিদারি চালে চলেন। দোতলায় তার কোয়ার্টার, সারাদিন সেখানেই থাকেন। খুব গোলমেলে ব্যাপার হলে ফোন ধরেন, সেও কদাচিৎ, বাসায় মাদ্রাজি সিল্কের লুঙ্গি পরে থাকেন আর রঙিন গেঞ্জি। সন্ধ্যা সাড়ে আটটার পরে স্নান-টান করে, পাউডার মেখে চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি আর আলিগড়ি পাজামা পরে থানার অফিস ঘরে দর্শন দেন।

হাজারি হাজরার পূর্বাশ্রমে নাম ছিল ক্ষেত সরকার। হাজরা ফাঁড়িতে এক নাগাড়ে বহু বছর আছেন তাই পাবলিক তাকে মিঃ হাজরা বলে সম্বোধন করে এবং সেই সঙ্গে উনি হাজার টাকার কম ছেন না বলে নাম হয়েছে হাজারি, দুইয়ে মিলে হাজারি হাজরা।

হাজারি হাজরা নবযৌবনে নকশাল হয়েছিলেন। তারপর উনিশশো পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর সালে জরুরি অবস্থার গলিঘুজি দিয়ে দারোগাগিরিতে ঢুকে পড়েন। তদবধি বহাল তবিয়তে আছেন, যখন যে গাছে নৌকো বাঁধা উচিত, সেখানেই নৌকো বাঁধেন।

আজ সন্ধ্যাবেলা একটু আগেই একটা গোলমেলে খবর এসেছিল। থানার অদূরে অনিল ঘোষাল লেনে অনেকদিন ধরে একটা বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে গোলমাল চলছিল। বাড়িওয়ালা সপ্তাহ তিনেক আগে মারা গেছেন। গতকালই ভাড়াটে গজু শ্রীমানী এক গামলা লিচু আর আম, সেই সঙ্গে নগদ হাজার টাকা দিয়ে গেছে।

একটু আগে খবর এসেছে বাড়িওয়ালার বিধবা স্ত্রী ও বোনকে প্রায় উলঙ্গ করে গজু রাস্তায় প্যারেড করাচ্ছে। এইরকম সময়ে গা ঢাকা দেওয়াই রীতি।

সমাজসেবী যুবকেরা দারোগাবাবুকে উদ্ধার করল। তাদের মুখে নীল ছবির বার্তা পেয়েই, থানার ভার এক সদা অর্ধনিদ্রিত জমাদারের ওপর ছেড়ে দিয়ে, তিনি অকুস্থলে রওনা হলেন।

তখনও দামিনী মহীতোষকে নিয়ে পার্ক থেকে ফেরেনি। প্রেমতোষবাবু টিভির বিচিত্র লীলা উপভোগ করছেন, এমন সময় সদলবলে হাজারি হাজরার প্রবেশ।

স্বভাবতই প্রেমতোষবাবু একটু হকচকিয়ে গেলেন। টিভিতে এখন তার রঙের খেলা ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছিল না। নীলরংটা গাঢ়, আরও গাঢ় হতে হতে হঠাৎ ফিকে, হালকা হয়ে গিয়ে চুপসে যাচ্ছিল, আবার গাঢ় হচ্ছিল।

হাজারি হাজরা নিজের হাতের রুলটা নাচিয়ে একটা ধমক দিলেন প্রেমতোষের দিকে তাকিয়ে, কী, এসব কী, হচ্ছেটা কী?

প্রেমতোষ চৌধুরীও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, একটা সামান্য টিভি সেটের মধ্যে এতটা বর্ণবৈচিত্র্য তিনি আশা করেননি।

দারোগাবাবু এবার তার ডানদিকে দাঁড়ানো বিহারি জমাদারকে বললেন, তেওয়ারি, হাত লাগাও, আর প্রেমতোষকে বললেন, আপনাকে একবার আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

কিন্তু প্রেমতোষবাবুকে থানায় যেতে হল না। জমাদারসাহেব টিভির নবে তার লাঠির খোঁচা দিয়ে সেটা বন্ধ করতে গিয়েছিলেন। পরিণাম যা হল অতি ভয়াবহ। পুরো টিভির বাক্সটা থরথর করে কেঁপে শূন্যে ছয় ইঞ্চি লাফিয়ে উঠল। তার ভেতর থেকে তীব্র নীল জ্যোতি এবং শতশত শঙ্খ গর্জনের শব্দ বেরতে লাগল। সপারিষদ হাজারিবাবু ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন।

এই সময় মহীতোষবাবু দামিনীর সঙ্গে বাসায় ফিরে এসেছেন। দামিনীর উপস্থিত বুদ্ধি অতি প্রখর। সে ছুটে সিঁড়ির নীচে গিয়ে মেইন সুইচটা অফ করে দিল।

টিভির গর্জন ও শূন্য পরিক্রমা বন্ধ হল। কিন্তু নীল আলোটা রয়ে গেল। গতিক সুবিধের নয় দেখে হাজারি হাজরা পশ্চাদপসরণ করলেন।

পরদিন সকালে টিভি সেটটাকে তুলে নিয়ে মহীতোষবাবু পাড়ার মোড়ের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসেছেন। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত, অবৈজ্ঞানিক কারণে একটা অতি ক্ষীণ নীল আলোর রেশ।

এখনও রয়ে গেছে; প্রেমতোষবাবু ঘরে ঢুকলেই সেটা টের পান।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments