Tuesday, June 17, 2025
Homeগল্প কথারেলগাড়িতে – লীলা মজুমদার

রেলগাড়িতে – লীলা মজুমদার

রেলগাড়িতে – লীলা মজুমদার

এর আগেও বলেছি ট্রেনে অচেনা লোকদের সঙ্গে যেমন গল্প জমে, তেমন আর কোথাও নয়। বিশেষ করে যদি তাদের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবার সম্ভাবনা কম থাকে। এসব লোকদের কী না বলা যায়। মনের সব গোপন কথা নিশ্চিন্তে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়। তবে আমাদের মতো যাদের দৌড় হাওড়া থেকে বোলপুর স্টেশন, তাদের পক্ষে সেরকম কাঠ অচেনা পাবার সম্ভাবনা কম। তবু তাই বা মন্দ কী।

গত বছর একটা কামরায় উঠলাম, তার দরজা বন্ধ হয় না। বন্ধ হবার হাত-ছিটকিনি কিচ্ছু নেই। হাতে হাতে জিনিসপত্র নিয়ে তার পাশের গাড়িতে চড়লাম। তার দরজাটা আবার এমনি এঁটে গেল যে খোলাই যায় না। তা ছাড়া আলো জ্বলে না, পাখা বন্ধ হয় না।

বলিষ্ঠ প্যাটার্নের অল্পবয়সি এক যাত্রী সস্ত্রীক এসে ভদ্রভাবে হাঁকডাক করতে লাগলেন, ‘দয়া করে ছিটকিনিটা খুলে দিন।’ বলা হল ‘ছিটকিনি খোলা আছে, জোরে ধাক্কা দিন।’ অগত্যা অনেক পরিশ্রম করে দরজা খোলা হল, আলগোছে বন্ধ করা হল, হাতল ঘোরানো হল না। তবু একটা সন্দেহজনক ক্কট শব্দ হল।

আগন্তুক দু’জন বাংলাদেশ থেকে ১৫ দিনের ভিসা নিয়ে, এই প্রথম ভারত দেখতে এসেছেন। দিল্লি রাজস্থান সফর করে, আপাতত শান্তিনিকেতনে যাচ্ছেন।

আরেকবার ধাক্কাধাক্কি করে দরজা খুলে একজন আধবয়সি ভদ্রলোক ঢুকলেন। তিনি বিশ্বভারতীর বিশিষ্ট অধ্যাপক। একজন চালাক-চতুর চেহারার পদাধিকারীও উঠলেন। মনে হল রেলের এঞ্জিনিয়ার গোছের কেউ। আমাদের অভিযোগ শুনে বার দশেক দরজাটাকে খুলে বন্ধ করে, প্রমাণ করে দিলেন ওটি আটকে যাওয়া অসম্ভব! ইনিও কার্যব্যপদেশে এই লাইনে হামেশাই যাওয়া-আসা করেন। বলাবাহুল্য, দরজা আর আটকাল না। কুকুর মুগুর চেনে।

৮-১০ বছরের মেয়ে নিয়ে একজন যুবক উঠলেন। তাঁর মামার বাড়ি শান্তিনিকেতনে। কয়েকজন উৎসাহী ছাত্রগোছের ছোকরা উঠল। তারা গুসকরায় নামবে। এ অঞ্চল তাদের নখদর্পণে। দেখতে দেখতে গল্প জমে উঠল।

লুপ-লাইনে সর্বদা পুরনো প্রায়-অচল গাড়ি দেয়। লুপ-লাইনে ঢুকেই গাড়ি আঘাটায় দাঁড়িয়ে গেল। পদাধিকারী বিরক্ত হয়ে নেমে গেলেন। বলে গেলেন, ‘এ ইঞ্জিন আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। এর বজ্জাতির শেষ নেই। এবার আমি অবসর নিচ্ছি, তাপ্পর একে কে ঠেকাবে দেখব!’

শেষটা তাঁর নির্দেশে লাইনের পাশে পড়ে থাকা কাঠের তক্তা ইঞ্জিনের কোনও বিশেষ জায়গায় গুঁজে দেওয়াতে সে আবার চলতে শুরু করল।

ছোট ছোট কামরা। দরজা খুললেই প্ল্যাটফর্ম। চারজনের জায়গায় দশজন যাত্রীকে ঠেসেটুসে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসতে হল। দুজন তো অতি বিপজ্জনকভাবে চায়ের পেয়ালা রাখার নড়বড়ে শেল্‌ফ আঁকড়ে-পাকড়ে রইল। গল্প জমার এমন ভাল পরিবেশ আর কোথায় পাওয়া যাবে?

বাংলাদেশের ছেলে-বউকে বিদেশি বললে হাস্যকর ব্যাপার হয়। হালচাল, কাপড়চোপড়, কথাবার্তা আমাদের ঘরের মতো। খালি ‘আজ্ঞে’ না বলে, বলল ‘জি’, এই যা তফাত। অধ্যাপকমশাই একজন নামকরা নৃতত্ত্ববিদ, দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় ঘুরেছেন। এঁদের কথায় বোঝা গেল দেশ-বিদেশ বলে আলাদা দুটো জিনিস নেই। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল, কামরায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কারও পৈতৃক বাড়ি ঢাকায়, মামাবাড়ি চাটগাঁয়ে; কারও বাড়ি চাটগাঁয়ে, মামাবাড়ি সিলেটে; কারও শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লায়, থাকেন ঢাকায়; আমার বাপের বাড়ি ময়মনসিংহে, শ্বশুরবাড়ি কুষ্ঠিয়ায়, বাস করি পশ্চিমবাংলায় আর হোমটাউন লিখি কলকাতা, যেখানে আমি জন্মেছি।

অধ্যাপক ভারতের পূর্ব সীমান্তে অনেকদিন ধরে নানা তথ্যাদি সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। অনেকের ধারণা যেখানে পশ্চিমবাংলা শেষ হয়ে বাংলাদেশ শুরু হয়েছে, সে জায়গায় অস্ত্রধারী সৈন্যসামন্ত বিজবিজ করছে; কামান, কাঁটাতারের বেড়া, রক্ষীবাহিনী, পারমিট, বিপদ। আজ শুনলাম কয়েকটা বিশেষ জায়গায় ওই ধরনের পরিস্থিতি হলেও, আসলে কোথায় যে একটা দেশ শেষ হয়ে অন্যটা শুরু হল, তা টেরও পাওয়া যায় না।

প্রাকৃতিক দৃশ্য, বাড়িঘর, হালচাল, কথাবার্তা সব একরকম। তারা যে কোন দেশের নাগরিক সেটা নিজেদের মনে থাকে কি না সন্দেহ। কার্যব্যপদেশে অধ্যাপকমশাইকে ওইরকম এলাকায় যেতে হয়েছিল। মুশকিল হল, তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হবে, অথচ কোন দেশে যে আছেন তাই বোঝা যাচ্ছে না।

তারই মধ্যে শুনলেন যে সম্প্রতি ভাগাভাগি কি ওইরকম কিছু নিয়ে একটা পরিবারের মধ্যে মহা অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল, ‘ডাক মামুকে! মামু এসে ঠিক করে দিয়ে যাক।’ মামু কোথায়? না, ওপারে। এঁরা জানতে চাইলেন নদী-টদি আছে নাকি যে ওপারে?

গ্রামবাসীরা হাসতে লাগল, ‘না কত্তা, অদ্দূর যেতে হবে না। এই তো এইখানে, সীমান্তটুকুর ওপারে।’ অধ্যাপক অবাক হলেন। ‘এপারের জমি নিয়ে বিবাদ, তা ওপারের লোক এসে মীমাংসা করে দেবে মানে?’

গ্রামবাসীরা অবাক হল, ‘তা দেবে না? পাঁচ পুরুষ ধরে এদের পরিবারের সব সমস্যা ওরা মিটিয়ে দিচ্ছে। এখন আবার কী এমন হল যে দেবে না?’

এই তো সীমান্তের ব্যাপার।

অধ্যাপককে আরেকজন বললেন, ‘সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি কাছাকাছি বাড়িঘর। তারই মধ্যিখান দিয়ে সীমান্তরেখা টেনে দিয়েছে। চাচা তো চটে লাল, ‘ই কী! ভায়ের বাড়ি পড়ল ওদেশে, আমারটা এদেশে। ওদের বাড়ি থেকে মরিচ চেয়ে আনতে কি পারমিট নিতে হবে?’

শেখ বললেন, ‘বউয়ের বাপের বাড়ি ওদিকে পড়েছে। তোমার ভায়ের বাড়ির পাশেই। আমাদের বাড়ি এদিকে। কেঁদেকেটে বউয়ের চক্ষু লাল! তার চেয়ে তোমার ভাইকে বল পোঁটলা-পাটলি নিয়ে অখনি চলে আসুক আমাদের বাড়ি। আমরাও ওদের বাড়ি যাই।’ ব্যস, মিটে গেল।

এক কোঁকড়া-চুল যুবক বললে, ‘শুধু দেশ কেন, ভাষার কথাই ধরুন না। কোনটা দেশি, কোনটা বিদেশি কথা তার কিছু ঠিক আছে? বারাসতের দিকে পথের ধারে, চায়ের দোকানে চা খাব। জিগগেস করলাম, ‘ভাঁড় ছাড়া পেয়ালা-পিরিচ নেই?’ তা এক মাস্তান বসেছিলেন, তিনি দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘অত ইংরেজি বিদ্যে জাহির করতে হবে না মশাই। প্যায়লা-পিরিচ! কেন, সোজা বাংলায় কাপ্‌-ডিশ্‌ বলতে বুঝি অপমান লাগে?’

অধ্যাপকেরও ওইরকম অভিজ্ঞতা। পশ্চিমের কোনও শহরে রিক্‌শায় উঠে বললেন, ‘সচিবালয়।’ রিকশাওয়ালা রেগে উঠল, ‘ইংরেজি বাৎ ছোড় দিজিয়ে। ওসব দিন চুকে গেছে। যেতে চান তো সিধা হিন্দি বলুন।’

অধ্যাপক বুদ্ধি করে বললেন, ‘সেক্রেটারিয়েট।’ রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে তাঁকে সচিবালয়ে নিয়ে গেল।

বোলপুর স্টেশনে যখন সবাই মিলে নামলাম, তখন কার দেশ কোথায়, তাই নিয়ে সকলেরই একটু গোলমাল লাগছিল। আমার মামাবাড়ি আবার ফরিদপুরে; সেখানে বাংলাদেশের ছেলেটির মামাবাড়ি।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments