Sunday, June 29, 2025
Homeগল্প কথাশিকড় – হুমায়ূন আহমেদ

শিকড় – হুমায়ূন আহমেদ

শিকড় – হুমায়ূন আহমেদ

মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা শহরে খাট, মিটসেফ, চেয়ার-টেবিল এবং লেপ-তোষক বোঝাই করে কিছু ঠেলাগাড়ি চলাচল করে। ঠেলাগাড়ির পেছনে পেছনে একটা রিকশায় বসে থাকেন এইসব মালামালের মালিক। তাঁর কোলে থাকে চাদরে মোড়া বার ইঞ্চি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি কিংবা টু-ইন-ওয়ান। তাকে খুবই ক্লান্ত ও উদ্বিগ্ন মনে হয়, কারণ একইসঙ্গে তাকে লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে ঠেলাগাড়ির দিকে এবং তার কোলে। বসানো পরিবারের সবচে মূল্যবান সামগ্রীটির দিকে। তাকে খুব অসহায়ও মনে হয়। অসহায়, কারণ এই মুহূর্তে তার কোন শিকড় নেই। শিকড় গেড়ে কোথাও না বসা। পর্যন্ত তার অসহায় ভাব দূর হবে না।

মানুষের সঙ্গে গাছের অনেক মিল আছে। সবচে বড় মিল হল, গাছের মত মানুষেরও শিকড় আছে। শিকড় উপড়ে ফেললে গাছের মৃত্যু হয়, মানুষেরও এক ধরনের মৃত্যু হয়। মানুষের নিয়তি হচ্ছে তাকে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হয় চূড়ান্ত মৃত্যুর দিকে।

শিকড় ছড়িয়ে দেবার জন্যে গাছের অনেক কিছু লাগে–নরম মাটি, পানি, আলো, হাওয়া। মানুষের কিছুই লাগে না। কয়েকটা দিন একটা জায়গায় থাকতে পারলেই হল, সে শিকড় গজিয়ে ফেলবে এবং অবধারিতভাবে শিকড় উপড়ানোর তীব্র যাতনায় এক সময় কাতর হবে। দৃশ্যটা কেমন? একটা পরিবারের কথাই মনে করা যাক। ধরা যাক, এরা চার-পাঁচ বছর একটা ভাড়া বাড়িতে থেকেছে। বাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালাদের স্বভাবমত এদের নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে। ঠিকমত পানি দেয়নি। বাড়িভাড়া বাড়িয়েছে দফায় দফায়, শেষ পর্যন্ত নোটিশ দিয়েছে বাড়ি ছাড়ার। এরা বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে।

নতুন একটা বাড়ি পেয়েছে, যেটা এই বাড়ির চেয়েও সুন্দর। ভাড়া কম, সামনে খানিকটা খোলা জায়গাও আছে। পরিবারের সবাই এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এই পচা বাড়ি ছেড়ে দিতে পেরে তারা খুবই আনন্দিত। কিন্তু পরিবারের কত্রী মনের কষ্ট পুরোপুরি ঢাকতে পারছেন না। বারবারই তার মনে হচ্ছে, এই বাড়ি ঘিরে কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।

তাঁর বড় ছেলের জন্ম হলো এই বাড়িতে। এই বাড়িতেই তো সে হাঁটতে শিখল। টুকটুক করে হাঁটতো, একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে কি প্রচণ্ড ব্যথাই না পেল। প্রথম কথা শিখে পাখি দেখে উত্তেজিত গলায় বলেছিল, পা… পা… পা…

তিনি বাধাছাদা করছেন, পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে আর চোখ মুছছেন। জিনিসপত্র সরাতে গিয়ে বাবুর ছমাস বয়সের একটি জুতা পেয়ে গেলেন। বাবু বেঁচে নেই, তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মৃতের কিছু জমা করে রাখতে নেই। কিন্তু তার একপাটি জুতা কিভাবে থেকে গেল? এই জুতায় এখনো বাবুর গায়ের গন্ধ।

তিনি ঘর গোছানো বন্ধ রেখে স্বামীকে নিচু গলায় বললেন, কিছু বেশি ভাড়া দিয়ে থেকে গেলে কেমন হয়? স্বামী খুব রাগ করলেন। কি আছে এই বাড়িতে যে এখানেই থাকতে হবে? এ বাড়ি নরক ছাড়া আর কি? নচ্ছার বাড়িওয়ালা। বাসা ছোট। আলো নেই, বাতাস নেই।

যেদিন বাসা বদল হবে সেদিন ছোট বাচ্চা দুটা কাঁদতে লাগলো। তারা এই বাসা ছেড়ে যাবে না। বাবা হুংকার দিলেন, খবরদার, নাকি কান্না না। এরচে হাজার গুণ ভাল বাসায় তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি।

বাবা জিনিসপত্র ঠেলাগাড়িতে তুলে বাসার চাবি বাড়িওয়ালাকে দিতে গেলেন। চাবি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বাড়িতে তার প্রোথিত শিকড় ছিড়ে গেল। তীব্র কষ্টে তিনি অভিভূত হলেন। তাঁর চোখে পানি এসে গেল। নতুন বাসার জন্যে এডভান্স টাকা দেয়া হয়ে গেছে। তার মত দরিদ্র মানুষের জন্যে অনেকগুলি টাকা। তারপরেও তিনি বাড়িওয়ালাকে বললেন, ভাই সাহেব, ছেলেমেয়েরা এই বাসা ছাড়তে চাচ্ছে না। চারদিকে পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা তো… আচ্ছা না হয় পাঁচশ টাকা বেশিই দেব… তাছাড়া ইয়ে, মানে আমার বড় ছেলে এই বাড়িতেই জন্মাল, আমার স্ত্রী মানে। মেয়েমানুষ তো, ইমোশনাল, বুঝতেই পারছেন না… ছেলের স্মৃতি…,

বাড়িওয়ালা রাজি হলেন না। বাবা ভেজা চোখে ছোট্ট টিভিটা কোলে নিয়ে রিকশায় উঠে বসলেন

অনেকদিন ধরেই আমি এই শহরে আছি। কতবার বাসা বদলালাম। প্রতিবারই এই কাণ্ড। বছরখানিক আগে শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের বাসাটা ছাড়লাম। অনেকদিন সেখানে ছিলাম। কত সুখস্মৃতি! বাসার সামনেটা গাছগাছালিতে ছাওয়া। গাছে বাসা বেঁধেছে টিয়া। একটি দুটি না–হাজার হাজার। বারান্দায় বসে দেখতাম, সন্ধ্যা হলেই ঝাক বেঁধে টিয়া উড়তো। আমার মেয়েরা গাছের নিচে ঘুরঘুর করতো টিয়া পাখির পালকের জন্যে। এরা পাখির পালক জমাতো।

হলের সঙ্গেই কি বিশাল দীঘি! কি পরিষ্কার টলটলে পানি! বাধানো ঘাট। কত জোছনার ফিনকি ফোটা রাতে আমি আমার ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে নেমে গেছি। দীঘিতে। এই দীঘিতেই তো বড় মেয়েকে সঁতার শেখালাম। প্রথম সঁতার শিখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে আমার মেয়ে একা একা মাঝ পুকুরের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ভয় পেয়ে ফিরে এল। কি সুন্দর দৃশ্য!

হলের সামনের মাঠে আমার তিন কন্যা সাইকেল চালাতে শিখলো, আমি তাদের ইন্সট্রাকটার। সাইকেল নিয়ে প্রথমবারের মত নিজে নিজে কিছু দূর এগিয়ে যাবার আনন্দের কি কোন সীমা আছে? না নেই। এই আনন্দ আকাশ থেকে প্যারাটুপারের প্রথম ঝাঁপ দেয়ার আনন্দের মত। আমার কন্যাদের আনন্দের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই হল।

হলের বাসার টানা বারান্দায় বসে রাত জেগে কত লেখালেখি করেছি। গুলির শব্দে মাঝে মাঝে লেখায় যেমন বাধা পড়েছে তেমনি অন্যরকম ব্যাপারও ঘটেছে। হঠাৎ শোনা গেল–বাশি বাজছে। কাঁচা হাতের বাজনা না, বড়ই সুন্দর হাত। লেখালেখি বন্ধ করে বাঁশি শুনেছি।

আমার হলের নিশিরাতের সেই বংশীবাদক জানে না আমি কত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম তার বাশির জন্যে। সে ভাল থাকুক, তার জীবন মঙ্গলময় হোক–এই প্রার্থনা। কত আনন্দ পেয়েছি তার জন্যে!

সেই হল ছেড়ে দেবার সময় হল। বহু দূর প্রোথিত এই শিকড় ছিঁড়তে হবে।

কি কষ্ট! কি কষ্ট!!

ঠিক করলাম, একদিনে হল ছেড়ে যাব না। ধীরে ধীরে যাব। প্রথম দিন হয়তো বইগুলি নেয়া হবে, দ্বিতীয় দিনে শুধু চেয়ার, তৃতীয় দিনে ফুলের টব… এইভাবে এক মাসের পরিকল্পনা। বোঝাও যাবে না। আমরা হল ছাড়ছি। করাও হল তাই। বাচ্চাদের আগে আগে পাঠিয়ে দেয়া হল। আমি এবং আমার স্ত্রী হল ছাড়লাম এক গভীর রাতে।

শেষবারের মত শূন্য ঘরে দাঁড়িয়েছি। ছোট বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছি, গুলতেকিন বলল, তোমরা যখন এত খারাপ লাগছে তখন হল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? থেকে যাও।

থেকে যাও বললেই থেকে যাওয়া যায় না। প্রোথিত শিকড় ছিঁড়তে হয়। হয়ত এই শিকড় ছেঁড়ার মধ্য দিয়েই কেউ একজন আমাদের আসল শিকড় ছেঁড়ার কথা মনে করিয়ে দেন…

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments