Monday, June 30, 2025
Homeছোট গল্পশুখাপুকুরে বৃষ্টি

শুখাপুকুরে বৃষ্টি

শুখাপুকুরে বৃষ্টি

হতে পারে এ গ্রামের পাশ দিয়ে কোনোকালে পুনর্ভবা বয়ে গিয়েছিল।

তখন নিশ্চয় জলের স্রোত বইত এখানে। ঢেউ থাকত। ঢেউয়ের দোলায় মানুষের মন নৌকার মতোই দুলে উঠত। নৌকার পালের মতোই নারীরাও নিশ্চয় উঠত ফুলে ফুলে—তখন নিশ্চয় যৌবন ছিল চারদিকে। বসন্ত থই থই করত প্রকৃতি-মানুষের দেহে। মাছেরা খলবল করত নদীর ভেতর। জেলেরা জাল ফেলে ওত পেতে বসে থাকত। নদীর পাড় ঘেঁষে ফুটত কাশফুল, হাওয়ায় দুলত নিশ্চয়ই খুব।

এখন পুনর্ভবার স্মৃতি হয়ে সাপের শুকনা খোলসের মতো পড়ে আছে একটা খালচিহ্ন। শুষ্ক খটখটে। পানি নেই। কত দিন থেকে নেই, তার ধারণাও নেই কারও।

আশ্চর্যজনকভাবে সত্য যে এই জলকাদাবৃষ্টির দেশে, এই শ্যামলিমার দেশে, এই একটি গ্রাম কত দিন বৃষ্টিহীন।

কত দিন বৃষ্টি হয় না এখানে?

সবচেয়ে বৃদ্ধা যে, যার মাথার ঠিক নেই বলে গ্রামজুড়ে রাষ্ট্র হয়েছে, বলে, সে নাকি একবার ভিজেছিল বৃষ্টিতে। একবারই। যে বছর তার বিয়ে হয়েছিল; সুরুজপুর থেকে যখন তার বরযাত্রা বেরিয়েছিল, তখন তিন দিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। মেঘ নাকি নেমে এসেছিল দুই হাত মাথার ওপরে। মুরগি তাড়ানোর কঞ্চি দিয়ে ওই মেঘ ছোঁয়া যেত। আর পাশের খালে ফুটেছিল শাপলা। সাদা আর গোলাপি শাপলা। তার বিয়ে হয়েছিল ঝরঝর বাদলের মধ্যে। পালকির ভেতর পানি ঢুকে নাকি তার শাড়ি ভিজে গিয়েছিল। তার কপাল ভিজে গিয়েছিল। পায়ের আলতা ধুয়ে ধুয়ে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে আলতা বাঁচাতে বাঁচাতে সে নাকি পৌঁছেছিল শ্বশুরবাড়ি।

বৃদ্ধার মাথা খারাপ, তার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। এত বৃষ্টি কি কখনো হতে পারে এই কৃপাহীন গ্রামে?

কৃপাহীন এ গ্রামের নাম শুখাপুকুর। তা পুকুর একটা আছে এখানে। পুকুরটার অনেক নিচে অল্প একটু কাদার ওপর পানির ঝিকিমিকিও দেখা যায় কখনো কখনো। তখন গ্রামের মানুষেরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। এই পানি দিয়েই না তাদের ফসল হবে!

কিন্তু গ্রামের মানুষ যত না পুকুরের তলানিতে তাকায়, তার চেয়ে বেশি তাকায় মাথার ওপরের আকাশের দিকে। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে কোনো মেঘ দেখা যায় না। অথচ কে না জানে দেশটা মেঘের আর পাখির, গানের আর সৌরভের।

মেঘ নেই। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা জানে একদিন মেঘ আসবে। ঝরঝর করে বৃষ্টি ঝরবে। ওই বৃদ্ধা যেমন বলে, তেমনই তিন দিন, পাঁচ দিন, সাত দিন কি এক মাস ধরে বৃষ্টি হবে। মরা কঙ্কালের মতো গাছগুলো আবার সতেজ সবুজ হয়ে উঠবে। পুকুরটা, নদীটা, কুয়োটা পানিতে দূরের গাঁয়ের নববধূদের মতো ঢলঢল করবে। নিজেদের শরীরের ফাটা ফাটা চামড়াগুলো ভরে উঠবে, হয়ে উঠবে মসৃণ। বৃষ্টি আসবে আর সুখে তাদের সবকিছু ভেসে যাবে। গরু–ছাগলেরা, ফসলের খেতেরা, আমের–জামের গাছেরা, তাদের নারীরা হয়ে উঠবে আবার ফলন্ত। আবার বসন্ত হবে। থোকা থোকা ফুল ফুটবে চারদিকে। ফুলের রেণু ছড়িয়ে যাবে বাতাসের সঙ্গে। পাখিরা উড়বে, গান গাইবে। গাভির ওলান দুধে ভরে থাকবে, ছুটন্ত বাছুরেরা এসে গোত্তা মেরে দুধ খাবে। তার চোয়াল উপচে সাদা সাদা দুধ গড়িয়ে পড়বে মাটিতে।

মেঘ আসবে, বৃষ্টি আসবে।

বহু বহু দূরের গ্রামগুলোর মতো তাদের এই শুখাপুকুর গ্রামটাও ধূসর থেকে সবুজ-হলুদ-কলাপাতা হয়ে উঠবে।

কিন্তু আকাশ অবধারিতভাবেই থাকে ফাঁকা। পারদ রোদের এ আকাশে কোনো ছায়া নেই, কোনো বাজ-চিল-শকুন নেই। মেঘ তো নেই-ই। গ্রামবাসীর ভ্রু কুঁচকে যায় আকাশ দেখতে দেখতে। তারা স্বাভাবিকভাবে আর তাকাতেই পারে না। পুরো গ্রামটারই ভ্রু কুঁচকে থাকে—যেন সবার ওপরেই তারা তিতিবিরক্ত।

বয়স্ক গাছের বাকলের মতো গ্রামের লোকদের মুখে ভাঁজ জমে থাকে। চোখের নিচে, ঠোঁটের চারপাশে জমে থাকে ছোপ ছোপ অন্ধকার। এদের এত জলসংকট যে এমনকি চোখের পানিও বের হয় না। খাল-পুকুর-কুয়োর মতোই এদের চোখ থাকে শুকিয়ে, মন থাকে উষর। তবে পুকুরের ওই চিকচিকে জলের মতো বুকের কোথাও একটু আশা চিকচিক করতে থাকে তাদের—বৃষ্টি আসবে, মেঘ আসবে, ছায়া আসবে। এদের প্রত্যেকের ভেতর মন্ত্রের মতো বাজে, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই…


কিন্তু এরা গেয়ে ওঠে না। এরা গাইতে পারে না। মুখ দিয়ে শব্দগুলো উচ্চারিত হয় না, আটকে যায় ভেতরেই। এরা সুর ধরতে পারে না। ধরলেও ভুলে যায়। শুধু রক্তের ভেতরে কীভাবে শব্দগুলো আটকে যায় আর ঘুরপাক খেতে থাকে বারবার, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে…

আশা গোঙরাতে থাকে এদের বুকের ভেতর।

তবে সেদিন শুখাপুকুরের চোখ খুলল দ্রিমদ্রিম আওয়াজে। সবাই ভাবল, বোধ হয় আকাশের ওপার থেকে ডাকছে মেঘ। কৃষকেরা হাল ফেলে, জোয়ানরা কোদাল ফেলে, বধূরা উঠান ফেলে, মেয়েরা কোলের শিশু ফেলে বেরিয়ে এল বাইরে। আকাশ শূন্য। কিন্তু অতি দূর দিগন্তে দেখা গেল ধুলোর মেঘ। সেই মেঘের সামনে যেন আশ্চর্য এক উপায়ে কেউ একজন ভেসে আসছে। সবাই চমকাল একসঙ্গে। সবারই শ্বাস পড়তে শুরু করল তালে তালে। কে আসে? ওই যে দূরে কে আসে? উড়ে উড়ে কে আসে রে শুখাপুকুরে?

সে এক জাদুকর।

ঝাঁকড়া মাথার চুল। চোখে টানা কোনো দুনিয়ার সুরমা। ঠোঁট দুটোতে রহস্যের ধনুক-হাসি। বলল, কী, মেঘের বড় অভাব গো তোমাদের?

শুখাপুকুর ম্লান হয়ে গেল এ কথা শুনে। কত যে অভাব তাদের…তবে ঠিক, মেঘেরই তো অভাব। জলের অভাব। পানির অভাব। বড় অভাব বৃষ্টির। জাদুকর আঁক টানল মাটিতে। তর্জনীর শক্তিতে। সেই আঁকের ভেতর জমে উঠল পানি, কী লাগবে নাকি?

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল পুরো শুখাপুকুর। এতটুকুতে কিছুই হবে না যে! অনেক লাগবে। কুয়ো ভরতে হবে, পুকুর ভরতে হবে, খাল ভরতে হবে আর ওই যে সাপের মতো নদী…পুনর্ভবা…সেটাও পুনঃ ভরে উঠতে হবে।

জাদুকর বলল, তাহলে যে দিতে হবে কৌটো ফুলের মধুর স্বাদ!

কৌটো ফুল? সেটা আবার কেমন ফুল? কোথায় ধরে? গাছ আছে তার?

জাদুকর আর কিচ্ছু বলল না। ঘুমিয়ে পড়ল জারুলগাছের তলায়। শুখাপুকুর হাঁটতে হাঁটতে বনে গেল, বাদাড়ে গেল। কোথাও তো নেই কৌটো ফুলের রেণু। কোথাও নেই কৌটো ফুলের মধু। তাহলে কি আবার তারা শুকিয়ে যাবে? ধুলোর ভেতর গুমরে যাবে?

ও জাদুকর বলো, বলো, কোথায় পাব কৌটো ফুলের মধু? কেমন তার স্বাদ? জিবে ঠেকিয়ে বুঝতে পারব?

ঘুমের মধ্যেই জাদুকর আঁকল কিছু আঁক। তার ভেতরে কেমন যেন দাগ! ওই দাগের ভেতর বিন্দু। ওইখানেতেই কৌটো ফুল কিন্তু!

শুখাপুকুর এগিয়ে গেল সেই আঁকটা ধরে। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পুনর্ভবার ঢালে। সেখান থেকে আর যে কত দূর! ও জাদুকর, আর কত দূর?

দেখো…ভালো করে দেখো…।

এক শ সিঁড়ি নেমে গেছে পাতালপুরীর দিকে। ওপারে কী যে কালো গাঢ় আর পিছলে যাওয়া আঁধার! এক পা–দুপা করে নামল শুখাপুকুর। ছমছমে একসময়কালের ভেতর ধাক্কা খেল তারা। কী? কী যে এটা? মেঘ? মেঘের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া যায় কি?

মেঘ তো না। একটা গাছ। গাছ তো না, একটা দেয়াল। দেয়াল তো না, একটা কারও খেয়াল। দাঁড়িয়ে আছে কটমটিয়ে—কী চায়?

ফুল। ফুল চাই রে ভাই। কৌটা ফুলের মধু চাই রে ভাই। চাই তো তারই স্বাদ!

খেয়াল বলল, সে কী! এই জিনিস সবার চায় নাকি! সবাই তাইলে চাইছ অমর হতে?

অমর? কিন্তু এটা চাখলে পড়ে মেঘ…জাদুকরের জিবে পড়লে জল…তার স্বাদে পড়লে বৃষ্টি…

কী যে অনাসৃষ্টি! হয় নাকি কখনো? এ তো অমৃত। খেলে মরণ অন্য পাশে ঘুমায়। তোমায় আর কখনো ডাকবে না, জাগাবে না, দুহাত মেলে ধরবেও না। সবাই খাবে? বাঁচবে সবাই আজীবন?

ঘুম তাড়িয়ে দেখল জাদুকর—শুখাপুকুর তাকিয়ে তার দিকে।

শুখাপুকুর হাসতে হাসতে আলো। শুখাপুকুর খুশির চোটে লাল।

আমরা কি সব কাটব নিজের কবর?…রে জাদুকর, তুই একলা হবি অমর?

হাসতে হাসতে পুরো শুখাপুকুর ভরল মুখে কৌটো ফুলের মধু। কী সুন্দর! কী যে দারুণ স্বাদ! চোখগুলো হলো সবার ফুল। ঠোঁটগুলোতে ছড়িয়ে গেল রেণু। একে একে কৌটো ফুলের মধু ছড়িয়ে গেল শুখাপুকুরের শুষ্ক পেটের ভেতর।

আমরা অমর, আমরা অমর সবাই! পাতাল থেকে আনব এবার পানি!

আমরা অমর, আমরা অমর সবাই! পাতাল থেকে আনব এবার পানি!

জাদুকর বলল, খেয়াল তোমাদের ভুল বুঝিয়েছে বাপু। কৌটো ফুলের মধু খেলে কেউ অমর হয় না। আগেভাগেই মরে যায়।

তাই বুঝি? কই মরেছি আমরা? তুমি আমাদের ছল করছ! তুমি একলা খেয়ে অমর হতে চেয়েছ। আমাদের শুধু শুধু খাটিয়ে মারতে চেয়েছ!

জাদুকর তাকিয়ে থাকল আকাশের দিকে। তারপর আঁক টানল মাটিতে। মাথা নাড়াল। শুখাপুকুর তাকে এবার ঢিল মারতে শুরু করল—যা যা! দূরে যা! এই গ্রাম অমরের। এই গ্রাম জীবনের। এই গ্রামে ছল নেই। এই গ্রামে কোনো জাদুকরের ঠাঁই নেই! যা যা! শুধু তার আগে বলে যা, বৃষ্টি কখন আসবে? কীভাবে আসবে?

জাদুকর ধীরে বলল, মরে।

জাদুকর চলে গেল। যাওয়ার আগে শুষ্ক খেতের ভেতর ছড়িয়ে দিল একমুঠো সন্দেহের বীজ।

মরে যাওয়া পুনর্ভবার ওপর বসে ছিল বেঁচে থাকা শুখাপুকুর। অনেকক্ষণ। কিন্তু কোনো বৃষ্টি এল না। দিন গেল, রাত গেল। বৃষ্টি এল না। তারপর তাদের মনে হলো, জাদুকর ঠিক। মরতে হবে। কাউকে মরতে হবে। যেকোনো একজনকে। কিন্তু তারা তো অমর। তারা কি মরবে?

প্রথম খুনটা তারা করল সেই বৃদ্ধাকে। আশ্চর্যজনকভাবে মরে গেল বৃদ্ধা। তবে তারা কি অমর নয়?

তারা এরপর আরও কয়েকজনকে মারল। মরল সবাই। মৃত্যুর পর কেউই বেঁচে উঠল না। কিন্তু তাতে কী যায় আসে? তাদের মারতে হবে। আরও। তারা ক্রমাগত ছুরি চালাল এর-ওর পেটে। মারল পরস্পরকে। আর যখন একজনও বেঁচে থাকল না, যখন রক্তের ধারায় এক শতাব্দী পর পুনর্ভবায় প্লাবন উঠল, তখনই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটি পড়ল শুখাপুকুরে।

তাতে জাদুকরের ছড়িয়ে দেওয়া বীজ থেকে বেরোতে শুরু করল তৃণ। সেগুলো ভিজতে শুরু করল ঝমঝমানো বৃষ্টিতে। ক্রমাগত বৃষ্টির ভেতর যেন আকাশের নিচে নেমে এল মেঘেরা। এত মেঘ এত বৃষ্টি…কিন্তু শুখাপুকুরে তার কোনো সাক্ষী রইল না।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments