শিক্ষামূলক গল্প – একটি ছোট্ট মেয়ের বুদ্ধি
অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে এক গরিব মানুষ বাস করতেন। তিনি খুবই সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। সংসারে অনেক অভাব, কাজের তেমন সুযোগ নেই, তাই জীবিকা চালাতে খুব কষ্ট হতো। একদিন তিনি ভাবলেন, রাজার কাছে গেলে যদি কিছু টাকা ধার পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো কোনো ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করা যাবে।
সেই ভাবনা থেকেই তিনি রাজপ্রাসাদে গেলেন। রাজা ছিলেন খুব দয়ালু মানুষ। গরিব মানুষটি রাজার সামনে গিয়ে মাথা নত করে বলল,মহারাজ, আমি খুবই গরিব। একটু সাহায্য দরকার। আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা ধার দেন, তাহলে আমি খুবই উপকার পেতাম। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, দুই বছরের মধ্যে টাকা ফেরত দিয়ে দেব।
রাজা লোকটির কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, তুমি সৎভাবে বলেছো, আমি বিশ্বাস করেছি। এই নাও পাঁচ হাজার টাকা। ঠিক দুই বছরের মধ্যে ফেরত দিও।
লোকটি খুশি হয়ে টাকা নিয়ে চলে গেল। তিনি ব্যবসা শুরু করলেন, সংসারও কিছুটা চলতে লাগল।
কিন্তু দুই বছর কেটে গেল, লোকটি টাকাটা আর ফেরত দিল না। রাজা একদিন ভাবলেন, আচ্ছা, দেখে আসি তো, সে লোকটি কী করছে। হয়তো ভুলে গেছে।
তিনি ছদ্মবেশে লোকটির বাড়ি গেলেন। কিন্তু লোকটি কখনো বলে, আজ আমি বাড়িতে নেই, আবার কখনো কোনো অজুহাত দেখিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। একদিন রাজা আবার ছদ্মবেশে লোকটির বাড়িতে গেলেন। এবার দরজায় কেবল একটি ছোট মেয়ে বসে ছিল।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন,“বেটি, তোমার বাবা কোথায়?”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল,“বাবা স্বর্গের জল আটকাতে গেছেন।”
রাজা অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন,“তোমার দাদা কোথায়?”
মেয়েটি বলল,“ওনি এখন ঝগড়া ছাড়াই ঝগড়া করতে গেছেন।”
রাজা আবার বললেন,“তোমার মা কোথায়?”
মেয়েটি হেসে বলল,“মা এক থেকে দুই করতে গেছেন।”
এত অদ্ভুত কথা শুনে রাজা বিরক্ত হয়ে বললেন,“তুমি তাহলে এখানে বসে কী করছো?”
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল,“আমি তো বসে বসেই গোটা সংসার দেখছি!”
রাজা বুঝলেন, মেয়েটি ইচ্ছে করেই ধাঁধার মতো উত্তর দিচ্ছে। তিনি মেয়েটিকে স্নেহভরে বললেন,“বেটি, তুমি আমার সব প্রশ্নের এমন অদ্ভুত উত্তর দিলে, আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। একটু বুঝিয়ে বলবে?”
মেয়েটি বলল,“বলব তো অবশ্যই। কিন্তু তার আগে আপনি আমাকে একটা কথা দিন।”
রাজা বললেন,“তুমি যা চাও, আমি দেব।”
মেয়েটি বলল,“তাহলে আপনি কথা দিন, আপনি আমার বাবার ঋণ মাফ করে দেবেন।”
রাজা একটু ভেবে বললেন,“ঠিক আছে, আমি কথা দিলাম, তোমার বাবার ঋণ মাফ করলাম। এখন বলো, তুমি কী বলতে চাও।”
মেয়েটি হেসে বলল,“মহারাজ, আমি সব কথা কাল বলব। আজ নয়।”
রাজা অবাক হলেও কিছু বললেন না। তিনি পরদিন আবার লোকটির বাড়ি গেলেন। এবার পুরো পরিবার, বাবা, মা, দাদা আর সেই ছোট্ট মেয়েটিও উপস্থিত।
রাজা বললেন,“বেটি, তুমি কি তোমার কথা মনে রেখেছো?”
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল,“হ্যাঁ, মনে আছে। এবার সব কিছু বুঝিয়ে বলছি।”
মেয়েটি একে একে ব্যাখ্যা করতে লাগল,
“বাবা স্বর্গের জল আটকাতে গেছেন” – মানে, তখন বৃষ্টি হচ্ছিল আর আমাদের ঘরের ছাদ দিয়ে পানি পড়ছিল। বাবা ছাদ ঠিক করছিলেন। আকাশ থেকে যে জল নামে, আমরা একে বলি স্বর্গের জল। তাই বাবা ‘স্বর্গের জল’ আটকাতে গিয়েছিলেন।
“দাদা ঝগড়া ছাড়াই ঝগড়া করতে গেছেন” – মানে, দাদা রেঁজনি গাছ কাটতে গিয়েছিলেন। ওই গাছে অনেক কাঁটা থাকে। কাটতে গেলে গায়ে কাঁটা বিঁধে যায়, যেন কারো সঙ্গে ঝগড়া হচ্ছে। কিন্তু আসলে কেউ ঝগড়া করছে না। তাই বলেছি ‘ঝগড়া ছাড়াই ঝগড়া’।
“মা এক থেকে দুই করতে গেছেন” – মানে, মা ডাল ভাঙছিলেন। একটি ডাল ভাঙলে তা দুই ভাগ হয়ে যায়, মানে এক থেকে দুই।
“আমি বসে বসেই গোটা সংসার দেখছি” – মানে, আমি ভাত রান্না করছিলাম। ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা দেখার জন্য একটা চাল টিপে দেখছিলাম। একটিই চাল সেদ্ধ হলে বোঝা যায় পুরো ভাত ঠিক হয়েছে। তাই আমি বলেছিলাম, গোটা সংসার (মানে ভাত) আমি দেখছি।
সব শুনে রাজা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন,“তুমি তো অসাধারণ বুদ্ধিমতী। কিন্তু তুমি তো এই সব কথা গতকালও বলতে পারতে! তখন বলোনি কেন?”
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল,“মহারাজ, আমি তখন ভাত রান্না করছিলাম। আপনার সঙ্গে কথা বললে ভাত পুড়ে যেত বা কাঁচা থাকত, মা আমাকে বকা দিতেন। আর তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। আমি যদি বলতাম আপনি ঋণ মাফ করেছেন, কেউ বিশ্বাস করত না। কিন্তু আজ আপনি নিজে এসেছেন, তাই সবাই জানছে এবং খুশিও হচ্ছে।”
রাজা মেয়েটির বুদ্ধি ও সাহস দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি গলার মুক্তোর মালা খুলে মেয়েটিকে দিলেন। বললেন,“এটি তোমার বুদ্ধির পুরস্কার। তোমার বাবার ঋণ আমি আগেই মাফ করে দিয়েছি। এখন তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। যদি ভবিষ্যতে কোনো দরকার হয়, নির্ভয়ে আমার কাছে এসো।”
এই বলে রাজা বিদায় নিলেন। আর মেয়েটির পরিবার আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরল।
শিক্ষণীয় বার্তা:
-ছোটরাও অনেক সময় বড় কাজ করতে পারে।
-উপস্থিত বুদ্ধি, সততা ও সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলার গুরুত্ব অনেক।
-ধৈর্য ও বিশ্বাস কখনো ব্যর্থ হয় না।