শিক্ষামূলক গল্প – ভালো কাজর পুরস্কার
একটা সময়ের কথা। একটা ছোট্ট গ্রামে থাকতেন এক মৎস্যজীবী, নাম তার রাজু। প্রতিদিন সকাল হলেই তিনি তার জাল আর ছিপ নিয়ে নদীর ধারে চলে যেতেন মাছ ধরতে। তার সঙ্গে থাকত তার সঙ্গী মনু। রাজু খুব ধৈর্যশীল ও দয়ালু মানুষ ছিলেন। আর মনু ছিল একটু রাগী ও বাস্তববাদী।
সেদিন সকাল থেকে নদীর ধারে বসে ছিল রাজু আর মনু। ছিপ ফেলেছে কতবার, জালও ছড়িয়েছে বহুবার, কিন্তু একটাও মাছ ধরতে পারেনি তারা। দুপুর পেরিয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, তবু মাছ নেই।
মনু একটু রেগে বলল, “এইভাবে তো আমাদের খালি হাতে ফিরতে হবে আজ, আজ বোধহয় ভাগ্য ভালো নয়।”
রাজু শান্তভাবে বলল, “সবসময় মাছ পাওয়া যায় না। ধৈর্য ধরো। ঈশ্বর আমাদের দেখছেন।”
ঠিক তখনই রাজুর ছিপ কেঁপে উঠল। সে দ্রুত ছিপ টেনে তুলল আর চমকে গেল। এক বিশাল বড় রূপালি মাছ ধরা পড়েছে!
মনু খুশিতে চিৎকার করে উঠল, “এত বড় মাছ, এটা দিয়ে দু’জনের রাতের খাবার জমে যাবে।”
রাজুও হেসে বলল, “হ্যাঁ, আজ অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না।”
তারা খুশি মনে মাছ হাতে বাড়ির দিকে রওনা দিল। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের দিকে ফিরছিল তারা। তখনই একটা আবর্জনার স্তূপের পাশে চোখ পড়ল একজন লোকের ওপর। লোকটি খুব মলিন কাপড় পরা, মুখে ক্লান্তি, আর খুঁজে চলেছে কিছু খাবার।
রাজু তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ভাই, আপনি এখানে খাবার খুঁজছেন কেন?”
লোকটি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আজ আমি কাজে যেতে পারিনি। ঘরে খাবার নেই। আমার ছোট্ট মেয়ে সারাদিন কিছু খায়নি। তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি, যদি কিছু খেতে পাই।”
রাজু চুপ করে লোকটার কথা শুনল। তার চোখে মায়া ফুটে উঠল। সে তার ধরা মাছটার দিকে তাকাল, আবার লোকটার মুখের দিকে। তারপর একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে মাছটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এই মাছটা নিয়ে যান। আপনার মেয়েকে খাওয়ান। আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বর আমাদের জন্য কিছু না কিছু ঠিকই করবেন।”
লোকটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর তার চোখ ভরে উঠল আনন্দাশ্রুতে। সে বলল, “আপনি খুব ভালো মানুষ। ঈশ্বর আপনাকে আরও দান করুন!”
কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে মনু তখন বেশ বিরক্ত। সে রাগ করে বলল, “তুমি পাগল হয়েছ? আমরা সারা দিন বসে ছিলাম, একটা মাছ পেয়েছিলাম, আর সেটাও দিয়ে দিলে এক অচেনা লোককে? এখন আমরা কী খাবো?”
রাজু শান্তভাবে বলল, “মনু, কারও সাহায্য করতে হলে তাকে চেনা লাগে না। একটা ক্ষুধার্ত মানুষকে দেখে আমি চোখ বন্ধ করতে পারিনি। আমি জানি, ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করবেন না।”
মনু মুখ ফিরিয়ে বলল, “তোমার ঈশ্বর যদি পেট ভরায়, তবে দেখি।”
তারা দু’জনে চুপচাপ বাড়ি ফিরে এল। রাতের খাবার নেই, পেট খালি, কিন্তু রাজুর মুখে তবু এক শান্ত হাসি।
একটু পর হঠাৎ তাদের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। রাজু দরজা খুলে দেখল, সেই লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার সে ময়লা কাপড় নয়, পরেছে সুন্দর পোশাক, হাতে কিছু সুস্বাদু খাবার আর একটা প্যাকেট।
লোকটি হেসে বলল, “আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না, তাই না? আমি আসলে গরিব ছিলাম না। আমি একজন ব্যবসায়ী। আমি শুধু খুঁজছিলাম এমন মানুষ, যারা নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করে। আপনি সেই মানুষ। আজ আপনি প্রমাণ করেছেন যে সত্যিকারের দয়া আর ভালোবাসা এখনো আছে। এই খাবার ও উপহার আপনার জন্য। আর কাল থেকে আপনি আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করবেন। কারণ আপনি ভালো কিছু পাওয়ার যোগ্য।”
রাজু চমকে গেল। সে কিছু বলার আগেই মনু বলে উঠল, “তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমরা শুধু একটা মাছ নয়, আজ একটা চাকরিও পেলাম। কিন্তু তুমি এত নিশ্চিত ছিলে কীভাবে যে ঈশ্বর আমাদের নিরাশ করবেন না?”
রাজু হেসে বলল, “আমি ভবিষ্যৎ জানি না, কিন্তু আমি জানি, যখন তুমি মন থেকে কাউকে সাহায্য করো, তখন ঈশ্বর তোমার জন্য এমন কিছু প্রস্তুত রাখেন, যা তুমি কল্পনাও করতে পারো না।”
মনু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আজ আমি জীবনের একটা বড় শিক্ষা পেলাম। আমি আর কখনো কারও কষ্টে চোখ বন্ধ করব না। আজ বুঝলাম, ভালো কাজ কখনো বৃথা যায় না।”