Sunday, September 28, 2025
Homeশিক্ষামূলক গল্পসাপ আর বেজির শিক্ষনীয় গল্প

সাপ আর বেজির শিক্ষনীয় গল্প

সাপ আর বেজির শিক্ষনীয় গল্প

জঙ্গলের পাশে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল। গ্রামের শেষ প্রান্তে, গহীন গাছপালার ভেতরে ছিল কাঠুরিয়ার একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটা খুবই সাধারণ হলেও ভীষণ সুন্দর আর পরিপাটি ছিল। চারপাশে ঘেরা, ভেতরে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান, কয়েকটা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি আর কবুতর।

কাঠুরিয়ার সংসার খুবই ছোট, স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে আর সঙ্গে তার প্রিয় বেজি। কাঠুরিয়ার ছেলে তখন আট বছরের, নাম রাহাত। আর ছোট্ট মেয়েটির বয়স আড়াই বছর, নাম মিতা।

বেজিটিও এই সংসারের একজন হয়ে গিয়েছিল। কাঠুরিয়া যেদিন তাকে বনে পেয়েছিল, সে ছোট্ট ছিল তখন। কোলে নিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। তারপর থেকে বেজি ছায়ার মতো কাঠুরিয়ার সাথে সবসময় থাকতো। কখনো কোমরে বসে থাকে, কখনো উঠোনে খেলে বেড়ায়, আবার কখনো বাচ্চাদের সঙ্গে খেলে।

সব মিলিয়ে সংসারটা ছিল খুবই সুখের, যদিও কাঠুরিয়ার উপার্জন ছিল খুবই কম। প্রতিদিন সকালে সে জঙ্গলে যেত কাঠ কাটতে। কাঠগুলো কেটে বাড়িতে এনে শুকাতো, পরে বাজারে বিক্রি করত। এতে যা পেত, তাতেই সংসার কোনরকম চালাত।

একদিন হঠাৎ কাঠুরিয়ার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। জ্বর, মাথা ঘোরা, শরীর দুর্বল, কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না। কাঠুরিয়া খুব চিন্তায় পড়ে গেল। রান্নাবান্না নেই, বাচ্চাদের দেখাশোনা নেই, সব দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস চলে যায়, স্ত্রী কিছুতেই সুস্থ হলো না। কাঠুরিয়া বুঝল, সাধারণ ওষুধে কাজ হচ্ছে না। তখন গ্রামের লোকেরা তাকে বলল, জঙ্গলের শেষ মাথায় এক নামকরা বৈদ্য আছেন। তাঁর ওষুধে কঠিন রোগও ভালো হয়।

কাঠুরিয়া অনেক আশা নিয়ে একদিন ভোরে উঠে সে ঠিক করল, বৈদ্যের কাছে যাবে। স্ত্রীকে ঘরে রেখে, বাচ্চাদের খেলার কথা বলে দিয়ে, সে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু সে জানত না, ওই দিনই ঘটবে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা, যা তার জীবনের সবকিছুই বদলে দেবে।

সকালে রাহাত আর মিতা উঠোনে খেলছিল। খেলতে খেলতে হঠাৎ বলটা বেড়ার বাইরে চলে গেল। রাহাত দৌড়ে গেল বল আনতে। মিতা একা রইল উঠোনে।

ওদিকে উঠোনের কোণে একটা বড় মাটির হাঁড়ি ছিল, যেটাতে গরুর জন্য পানি রাখা হতো। মিতা ছোট্ট পায়ে হেঁটে গিয়ে তাতে হাত ডুবিয়ে খেলা শুরু করল। পানি ছিটিয়ে সে খিলখিল করে হাসছিল।

ঠিক তখনই জঙ্গলের দিক থেকে একটা অদ্ভুত সাপ এলো। এ সাপকে বলা হয় “দুমুখো সাপ”—এর দু’দিকেই মুখ, দেখতে খুব ভয়ঙ্কর। কিন্তু আসলে সে সাপটা শান্ত স্বভাবের ছিল। গরমে কষ্ট পেয়ে সে পানি খেতে এলো।

মিতা সাপ দেখে ভয় পায়নি। বরং ভেবেছিল খেলতে এসেছে নতুন বন্ধু। তাই সে হাত দিয়ে সাপটাকে ঠেলতে লাগল। দুমুখো সাপ কিছু বলল না, চুপচাপ পানি খেল, শরীর ঠান্ডা করল। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হলো না। কিছুক্ষণ পর আবার অন্য দিক থেকে এলো এক ভয়ঙ্কর গোখরা সাপ। তার ফণা তোলা, “ফোঁস ফোঁস” আওয়াজে সে এগিয়ে আসছিল পানির হাঁড়ির দিকে।

মিতা গোখরাকে দেখে খুশি হয়ে হাত তালি দিল। ভাবল, আগের মতো এটিও তার সঙ্গে খেলবে। তাই সে গোখরার মাথায় হাত দিয়ে আদর করলো।

গোখরা রেগে গিয়ে ফণা তুলল। একবার “ফোঁস” করল। মিতা আবারও হাত দিল। এবার গোখরা রেগে গিয়ে হয়ে ছোবল মারল।

মুহূর্তের মধ্যে বিষ ছড়িয়ে পড়ল ছোট্ট মিতার শরীরে। তার মুখ নীল হয়ে গেল, শরীর নিস্তেজ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

সবকিছু দেখছিল কাঠুরিয়ার পোষা বেজি। খাঁচায় আটকে থাকায় সে বের হতে পারছিল না। কিন্তু মিতার চিৎকার, গোখরার “ফোঁসফোঁস” শব্দ, সব শুনে সে খাঁচা ভেঙে বের হওয়ার চেস্টা করতে লাগলো। অবশেষে খাঁচা ভেঙে বেরোল।

তারপর শুরু হলো এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সাপ আর বেজির।

বেজি লাফিয়ে সাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। গোখরা ছোবল মারল, বেজি এড়িয়ে গেল। কখনো ঠোঁটে কামড়, কখনো শরীর পেঁচিয়ে লড়াই, উঠোনজুড়ে যেন ধুলোর ঝড় উঠল।

অনেকক্ষণ লড়াইয়ের পর অবশেষে গোখরা সাপ মাটিতে লুটিয়ে পরে মারা গেল। কিন্তু বেজিও তখন আহত, শরীরজুড়ে রক্ত। মুখে লেগে আছে সাপের কামড়ের দাগ।

তবুও বেজি হাল ছাড়ল না। সে দৌড়ে জঙ্গলে চলে গেল। সবাই জানে, বেজিরা বিশেষ কিছু গাছের পাতা খায়, যা খেলে সাপের বিষ নষ্ট হয়ে যায়। হয়তো সে নিজেকে বাঁচাতে সেই পাতার খোঁজে গেছে।

এদিকে রাহাত ফিরে এসে দেখল, তার ছোট বোন মাটিতে অচেতন, মুখ নীল হয়ে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে বেজি, মুখে রক্ত।

রাহাত ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, আব্বা! আব্বা! বেজি আমার বোনকে মেরে ফেলেছে!

ঠিক তখনই কাঠুরিয়া ফিরে এলো বৈদ্য নিয়ে। দৃশ্য দেখে সে হতভম্ব। মেয়ে মাটিতে পড়ে আছে, পাশে বেজি, মুখে রক্ত। ছেলে কাঁদছে, বলছে, বেজিই করেছে।

রাগে অন্ধ হয়ে কাঠুরিয়া কাঠের লাঠি তুলে এক আঘাত করল বেজির মাথায়। বেচারা বেজি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

বৈদ্য মিতাকে পরীক্ষা করল। তারপর বলল, এটা সাপের কামড়ের দাগ। বেজি কিছু করেনি।

এরপর বৈদ্য হঠাৎ দেখল, বেজির মুখে একটা গাছের টুকরা। সে বিস্মিত হয়ে বলল, এটা তো সেই বিশেষ গাছ, যা সাপের বিষ কাটায়। বেজি হয়তো জঙ্গলে গিয়ে গাছ খেয়ে এসেছে আর মেয়েটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে।

সব শুনে কাঠুরিয়ার বুক ফেটে গেল। সে কাঁদতে লাগল, আমার বেজি! তুই আমার সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিলি। অথচ আমি তোকেই মেরেই ফেললাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে বৈদ্যের ওষুধে মিতা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু বেজি আর ফিরে এলো না।

শিক্ষা
সেদিন কাঠুরিয়া একটা বড় শিক্ষা পেল। সে বুঝল, কোনো কিছু না ভেবে, যাচাই না করে, রাগে-ক্ষোভে সিদ্ধান্ত নিলে তার ফল হয় ভয়াবহ। বিশ্বস্ত প্রাণীকে হারিয়ে সে বুঝল, বিশ্বাস আর ধৈর্যের মূল্য কতটা বেশি।

GolpoKotha
GolpoKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments