Tuesday, June 17, 2025
Homeমজার গল্পসত্যবাদিতার পুরস্কার! – শিবরাম চক্রবর্তী

সত্যবাদিতার পুরস্কার! – শিবরাম চক্রবর্তী

সত্যবাদিতার পুরস্কার! – শিবরাম চক্রবর্তী

হোস্টেল-সুপার সত্যপ্রিয়বাবুকে, ঠিক ঠিক বলতে গেলে, যথার্থ বলতে হয়।

যেমন সম্মানে তেমনি নামের মানেও এক নম্বরের সত্যনিষ্ঠ লোক। সত্য ছাড়া তিনি নড়েন-চড়েন না—নাড়েন-চাড়েন না।

এহেন সত্যপ্রিয়বাবুর কাছে অর্ধসত্য চালাতে যাওয়া কামারশালায় ছুঁচ বিক্রি করার মতোই। নিতান্তই ছুঁচোর কাজ। আর, রতন কিনা, তাই করে বসেছে!

কাল সোমবার—সেইশকুল না গিয়ে—

সোজা চলে গেছে কলকাতায়। গড়ের মাঠেই সটান। মোহনবাগান-মহমেডানের ম্যাচ ছিল কালকে। কোনোরকমে নাকে-মুখে দুটো গুঁজেই-না রিষড়ের ছাত্রাবাস ছেড়ে সেবেরিয়েছে। যাকে বলে একবাসে বেরিয়ে যাওয়া।

না, ঠিক এক বাসে নয়। রিষড়ে থেকে বালি পর্যন্ত একটা বাস। তারপরে বালির খালে বাস বদল করে সেই বাসে হাওড়া। সেখান থেকে ফের পাঁচ-এ-র বাস ধরে খেলার ময়দান।

ফিরেছে সন্ধ্যের ঢের পরে।

ধরেছেন সত্যপ্রিয়বাবু—

রতনের কৈফিয়ত—ইশকুলের পথে দৈবাৎ মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল— অনেক দিনের পরে দেখা, ছাড়ল না তাকে কিছুতেই, ধরে পাকড়ে নিয়ে গেল বদ্যিবাটীতে—

‘তোমার মামাতো ভাই বদ্যিবাটীতে থাকে? এত কাছাকাছি থাকে, একথা তো কোনোদিন তুমি আমাদের জানাওনি? ঘুণাক্ষরেও না।’ এর কারণ জানতে চাইলেন সত্যপ্রিয়বাবু।

‘থাকত না তো। মাত্র কিছুদিন হল এসেছে। সেযে এখানে এসেছে, আমি তা জানতুমও না।’

‘নাম কী তোমার মামাতো ভায়ের? কী করে সেবদ্যিবাটীতে?’ শুধালেন সুপারিন্টেণ্ডেন্ট।

‘নাম? নাম তার বিপিন।’ নামতার মতো আউড়ে যায় রতন—‘ভুসোমালের আড়তে কাজ করে। আড়তদার আমার মামার বন্ধু। কারবারে আমার মামাদের অংশ আছে কিনা।’

‘কী বললে? ভুসোমালের আড়ত?’

‘হ্যাঁ, স্যার। আটার যেমন কল থাকে। তেমনি ভুসিরও—’

‘ভুসির কল! বলো কী হে? ভুসির আবার কল আছে নাকি? অ্যাঁ!’ সত্যপ্রিয়বাবুর বিস্ময় লাগে।—‘আমার ধারণা ছিল যে, আটার কল থেকেই ভুসি হয়।—মানে, পুরোপুরি ঠিক না হলেও…’ নিজসত্যের অপলাপকে নিজেই তিনি শুধরে নেন—‘আটার কল থেকে আটা আর ভুসি একসঙ্গে বার হয়,—আটকানো যায় না।’

‘ভুসির কল তো আমি বলিনি স্যার। আমি বলেছি ভুসির কারখানা।’

‘ভুসির কারখানা? সেআবার কী রকমের?’ আরও যেন তিনি বিকল হন।

‘মানে এইরকম। আটার কল থেকে আটা আর ভুসি একসঙ্গে বেরুল তো? তারপরে ভুসিদের সেই আটার থেকে বার করা হল। চাললেই তারা বেরোয়। এমন কিছু শক্ত না। একটা চালুনিতে, চালুনি তো জানেন স্যার? সরু সরু অনেক ফুটো থাকে? সেই তার মধ্যে আটা আর ভুসি একসঙ্গে ছাড়া হয়। তারপর চালুনি ধরে জোরসে নাড়লে—খানিক নাড়ানাড়ি করলেই—আটাগুলি তলিয়ে যায় আর ভুসিগুলো ভেসে ওঠে।’ বলেই রতনের মনে খটকা লাগে, হয়তো-বা তার সত্যকথনের মধ্যেই ভুসির মতোই কিছু ভেজাল থেকে গেল।—‘না, সত্যি বললে, ভেসে ওঠে না ঠিক। জলে তো পড়েনি যে ভাসবে? আটাগুলো গলে যেতেই ভুসিরা সেই চালুনির ফাঁদে আটকা পড়ে যায়—’

‘জানি, জানি। তোমাকে আর অত করে বোঝাতে হবে না।’ গমের থেকে আটা গজায়, আর আটার থেকে ভুসি—সত্যপ্রিয়বাবু এ তথ্য জানেন। কেবল গম যে কী করে আর কীসের থেকে জন্মায় তাই শুধু তাঁর জানা নেই।

‘এখন, স্যার, সেই ভুসিগুলো সব বার হল তো? তার জন্যে পয়সা লাগে, চালিয়েদের মজুরি দিতে হয় বেশ। তারপরে সেই সব আটা আর ভুসি আলাদা হয়ে আমাদের—মানে, আমার মামাদের কারখানায় এল। সেখানে আসবার পর তাদের দুজনকে—মানে সেই আটাকে আর ভুসিকে মিলিয়ে’—রতন পুনর্মিলন-কাহিনি প্রকাশ করে এবার—‘মানে, সেখানে আবার সেই ভুসিদের আটার সঙ্গে মিশিয়ে এক করা হয়—’

‘আবার এক করা হয়, মানে? তার মানে?’ এরকম একাকার করার সদর্থ সত্যপ্রিয়বাবুর মালুম হয় না।

‘আবার চালাবার জন্যে। চেলে আলাদা করে আবার ওদের ধরে ধরে মেশানোর জন্যেই। তারপর আবার ফের নতুন করে চালাবার জন্যে— চেলে আবার আলাদা করে আবার তাদের—’

‘তার মানে কী? এরকম করা হয় কেন? বার বার এই চালবার—এমন চালিয়াতির মানে কী?’ এই অনর্থক পন্ডশ্রমের তিনি অর্থ পান না।

‘পয়সা হয় যে।’ অর্থ বাতলায় রতন।

সত্যপ্রিয়বাবুর দুটি চোখ দুখানা জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে ওঠে। বিস্ময়ের আতিশয্যে তাঁর কথা বেরোয় না। রতনকে বাধ্য হয়ে তখন, এই যারপরনাই চালাচালির অর্থ কী এবং কোথায় এর অর্থ, সেটা খোলসা করতে হয়।

‘কলকাতার রাস্তায় দেখেননি স্যার, ‘‘চাই আটাভুসি’’ বলে কত লোক যে থলে কাঁধে করে ঘুরছে? তারা দু-আনা চার পয়সা সেরে ভুসি কেনে। আজকাল তো আটার সঙ্গে গমও দেয় রেশনে, আটাকল থেকে লোকে সেই গম ভাঙিয়ে নেয়। নিয়ে বাড়ি এনে চেলে ভুসি বার করে। সেই ভুসি জমিয়ে রাখে। ভুসিওয়ালাদের বেচে দেয় খুশি মতন। ভুসিওয়ালাদের কাছ থেকে সেই ভুসি মামারা ওদের কিছু লাভ দিয়ে সস্তায় কিনে নেয়। নিয়ে পাচার করে বদ্যিবাটীর এই কারখানায়।

সেখানে আটার সঙ্গে মিশিয়ে তাদের বস্তা বঁাধা হয়। তখন আটার সঙ্গে সং—সং—সংমিশ্রিত সেই ভুসিরও দাম হয়ে যায় সেরেক্কে দশ আনা। সঙ্গদোষেই এমনটা হয়ে থাকে স্যার। সেই আটাই আবার কেনে মানুষ! কিনে ফের চালে—চেলে আবার সেই ভুসি— ফের আবার সেই ভুসিওয়ালা—ফের আবার মামারা—আর এই করেই পয়সা! বেশ মজা করেই।’

আর বেশি বলতে হয় না। এক বস্তা আটা আর এক বস্তা ভুসি মিলতে পারলে যে দু-বস্তা দাঁড়ায়, এ তো জলের মতো সহজ। এ বুঝতে দেরি হয় না সত্যপ্রিয়র। আর সেই দু-বস্তায় লোকের দুরবস্থা যা-ই হোক-না, লাভ দাঁড়ায় চারগুণ, একথাও সত্যপ্রিয়বাবু বুঝতে পারেন। আটার কল থেকে ভুসির কারখানা পর্যন্ত সবগুলি কান্ড দিব্যচক্ষে তিনি দেখতে পান। ‘চাই ভুসি চাই’-য়ের হাঁকডাক আর তার মানেও যেন তাঁর দিব্যকর্ণে ধরা দেয়।

কিন্তু ভুসির মহিমা বুঝিয়ে সত্যপ্রিয়বাবুকে খুশি করা যায় না। মিথ্যাকথনের জন্যে না হলেও কামাইয়ের অপরাধে সাত দিন হোস্টেল থেকে বেরোনো বন্ধ হল রতনের। মানে, সাত দিন শুধু তার হোস্টেল থেকে ইশকুল আর ইশকুল থেকে হোস্টেল। এ ছাড়া বাইরে বেরোনো বন্ধ—কী সকালে, কী বিকেলে। কলকাতা অবধি পাড়ি মারা তো দূরের কথা খেলাধুলার ফাঁকে, কি, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে কখনো যে রাস্তায় গিয়ে একটুখানি—এই জিলিপির দোকান পর্যন্তও—ঘুরে আসবে, সেপথও খতম।

কিন্তু সামনের এই শনিবার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ না? খুব জোর খেলা, চ্যারিটি ম্যাচ তার ওপর! এ রকমের খেলার টিকিট পাওয়া চারটিখানি নয়। সকাল দশটা থেকে (ভোর পাঁচটা হলে তো ভালোই হয় আরও) ময়দানে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়লে, সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়তে পারলে তবেই যদি গ্রাউণ্ডে ঢোকার সুযোগ মেলে! আর এমন মোক্ষম খেলায় কিউয়ের এক-একটা লাইন মনুমেন্ট কি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল—কদ্দূর গড়াবে, কে বলতে পারে! সেই মনুষ্য-সারের সবচেয়ে সারাংশে, গ্রাউণ্ডের যতটা মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ানো যায়।

বেস্পতিবার সন্ধ্যের পরে কথাটা পাড়ল সেসুপারের কাছে। একটু ঘুরিয়ে পাড়ল—

‘আসছে শনিবার সকালে আমাকে ছুটি দিতে হবে, স্যার। সারাদিনের ছুটি মামার বাড়ি যাব আমি।’

‘তোমার সেই মামাতো ভাই, যে তোমাকে পাকড়েছিল, তার বাড়ি? বদ্যিবাটী যেতে চাও?’

‘না স্যার, কলকাতায়। মামারা থাকে কলকাতায়। আমার মামাতো ভাই কাজ করে বদ্যিবাটীতে—বদ্যিবাটীর ভুসিমালের কারখানায়। সেই কারখানার মালিক আমার মামার বন্ধু কিনা—’

‘জানি জানি, আর বিশদ করে বলতে হবে না। মামার খাতিরে তোমার মামাতো ভাইয়ের কাজটা হয়েছে, তাই তো তুমি বলতে চাও। আর এই ভুসিমালের কারবারে তোমার মামাদের একটা অংশ আছে, এই তো? মামারা ভুসি কিনে পাচার করেন কলকাতা থেকে, আর তোমার মামার যত চর-অনুচর সবাই মিলে ‘ভুসি চাই ভুসি চাই’ বলে ঘুরে বেড়ায় পথে পথে—এইসব কথাই তুমি বলবে তো? থামো। এই সবই আমার জানা।’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘কিন্তু তোমার আসল কারণ এ নয়। আমার দৃঢ় ধারণা, শনিবারের চ্যারিটি ম্যাচের সঙ্গে এই ছুটির কোনো নিগূঢ় সম্পর্ক আছে।’

‘না, স্যার।’ রতনের কর্ণমূল আরক্ত হয়ে ওঠে—‘মামার চিঠি পেয়েছি আজ সকালে। বাবা-মা এসেছেন দেশ থেকে। কয়েক দিন মোটে থাকবেন। দেখতে চেয়েছেন আমায়। শনিবার সকালে খুব ভোরে আমার মামাতো ভাই বদ্যিবাটী থেকে আসবে— এসে নিয়ে যাবে আমাকে। ছোটোছেলে তো আমি, একলা যেতে পারব না তো কলকাতায়।’

‘বটে?’ সত্যপ্রিয়বাবুর দুই চোখে ডবল বিস্ময়ের চিহ্ন দেখা দেয়।

‘যেতে আমি খুব পারি—’ বলতে গিয়ে আরও লাল হয়ে উঠল রতন—‘তবে কিনা একলা গেলে রাগ করবেন মামা। মাও ভারি ভাবনায় পড়বেন—ভাববেন কলকাতার পথেঘাটে এমনি বুঝি আমি একলা একলাই ঘুরে বেড়াই। ভেবে আরও বেশি ভাবিত হবেন। সেইজন্যেই আমি একলা যাব না। বাপ-মাকে ভাবিত করা কি ভালো স্যার? কোনো ভালো ছেলের পক্ষে উচিত কি?’

‘কই, দেখি সে-চিঠি!’

রতন কুন্ঠাজড়িত পদে চিঠি আনতে যায়, ফিরে আসে আরও ঢের কুন্ঠা জড়িয়ে। —‘চিঠিটা তো খুঁজে পাচ্ছিনে স্যার। কোথায় যে রাখলাম!’

‘আচ্ছা, ভেবে দেখি আমি! শনিবারের তো দেরি আছে এখনও। আজ তো সবে বেস্পতি। ভেবে দেখি এর মধ্যে—ছুটি দেয়া যায় কি না তোমায়।’

‘কিন্তু ইশকুলে আজ হেডমাস্টারমশায়ের কাছে ছুটির জন্যে অ্যাপলিকেশন করেছি যে—?’

‘কাল সন্ধ্যেবেলায় বলব তোমায়। তখন জানতে পারবে।’ জানান সত্যপ্রিয়বাবু।

শুক্রবার সকালে তিনি পোস্টাপিসে গিয়ে খোঁজ করেন। আগের দিন রতনের নামে কোনো চিঠি এসেছিল কি না, পিয়োনের কাছে খবর নেন তার। গতকাল কেন, বিগত সপ্তাহেই—শুধু রতনের কেন, হোস্টেলের কারোই কোনো চিঠি আসেনি জানা যায়।

সত্যবাবু মুচকি হাসেন—আপন মনেই। রতনের এই নিত্যকার অনৃতকথনের অভ্যেস দূর করতে হবে। এবার তাকে শিক্ষা দিতে হবে, অসত্য বলা যে কত গর্হিত, কদ্দূর ক্ষতিকর, উনি তা হাতেকলমে শেখাবেন আজ ওকে। মিথ্যেয় গজগজ করছে রতন। মিথ্যে দিয়েই মিথ্যের কাঁটা তুলতে হবে ওর মগজ থেকে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়, বলে না? ‘শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ’ বলে আছে-না একটা কথা? সেইরকম মিথ্যা সমাচার দিয়েই তার এতদিনের এই মিথ্যুকসম আচার শোধরাতে হবে। হ্যাঁ। এ ছাড়া আর পথ নেই।

শুক্রবার সন্ধ্যের পর রতন যখন তাঁর কাছে এসে দাঁড়াল, তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন—

‘দ্যাখো রতন, আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম, তোমার কথা সর্বৈব মিথ্যে। আমি আজ সকালে নিজে গেছলাম খবর নিতে বদ্যিবাটীতে—তোমাদের ভুসোমালের কারখানায়…’

‘অ্যাঁ, কী বললেন, স্যার…?’

‘সেই আটা-ভুসির আড়তে।’ ধীরে ধীরে তিনি তাঁর সরজমিন-তদন্তের কথা ব্যক্ত করতে থাকেন—‘তুমি তো বলেছিলে যে, তোমার মামাতো ভাই—বিপিন না কী নাম—সেনা এলে, এখানে এসে তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে না গেলে, তোমার তো যাওয়া হবে না? কলকাতার পথঘাটে একলাটি—এইসব বলেছিলে না?’

‘হ্যাঁ, স্যার। বলেছি তো।’

‘কারখানার মালিকের কাছে আমি খবর নিলুম বিপিনের। তোমার কথাও বললুম। শনিবার তোমাদের দুজনের কলকাতায় যাওয়ার কথাও। শুনে তিনি বললেন, শনিবার? শনিবার সেযাবে এখান থেকে? কী করে যাবে? তাকে আমি ছুটি দিলে তবে তো? ভারি বদ ছেলে মশাই, এই বিপিন! কাজে যদি তার একটুও মন থাকে—’

বিপিনের কথাগুলো, মিথ্যে কথা বলেই, পিনের মতন ফুটতে থাকে সত্যপ্রিয়র মনে। কিন্তু কী করবেন, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবেন বলে তৈরি হয়েছেন। নিজের মনে ব্যথা পেলেও উপরি-কাঁটাটা ফেলতে পারেন না—ভিতরি-কাঁটাটা রতনের ভিত থেকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত। অসত্যকথনের এই রোগ তাঁকে সারাতেই হবে—চিরকালের মতোই। যেমন করে হোক। এমনকী, নিজে অসত্য বলেও। বিষে বিষক্ষয়ের মতোই মিথ্যেবাদিতা দিয়েই এই মিথ্যে তাড়াতে হবে ওর।

‘অ্যাঁ…? রতন হাঁ হয়ে যায়।

‘যদ্দূর বোঝা গেল, তোমার এই মামাতো ভাইটি তোমার মতোই। মানে, আর একটি রতন।’ এই বলে তিনি রতনকে রতন চেনান—‘আটা-ভুসির মেলামেশার চাইতে যত বাজে মেলামেশায় তার মন। তা সে-রত্নটি তোমাকে না নিতে এলে তো তোমার যাওয়া হচ্ছে না? এবং তাকে ছাড়ছেই না যখন—তার এখানে আসাই হচ্ছে না যেকালে, তখন আর তোমাকে ছুটি দিয়ে কী হবে?’

‘কিন্তু আমি যে এদিকে হেডমাস্টারমশায়ের কাছেও ছুটি চেয়ে রেখেছি যে?’

‘তিনি না-মঞ্জুর করেছেন। আমিই নাকচ করালুম। আজ ইশকুলে গিয়েই তোমার কথা তাঁকে বলেছি আমি। এখন, এই একবেলার ছুটির জন্যে এত মিথ্যে বলে কী সুবিধে হল তোমার বলো তো? একটা মিথ্যের জন্যে, সেই মিথ্যেটা বজায় রাখতে আরও কতগুলো মিথ্যে তোমায় বলতে হয়েছে, ভেবে দেখেছ? এমন মিথ্যে বলে কি কোনো লাভ হয়? শিগগির হোক, আর পরেই হোক, ধরা তো পড়তেই হয়।’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘এখন আসল কথাটা কী, সত্যি করে বলবে আমায়? তাহলে এবারকার মতো তোমাকে মাপ করব। আর, কোনো শাস্তিও তোমায় দেব না, কিন্তু ঠিক ঠিক বলা চাই সব।’ তাঁর চিকিৎসায় কেমন কাজ হয়েছে, ওষুধটা কতখানি ধরল—সত্যপ্রিয়বাবুর পরখ করার ইচ্ছা হয়—‘সত্যি করে বলো তো, তোমার মামার কাছ থেকে সত্যি সত্যি কোনো চিঠি আসেনি? না?’

‘না, স্যার।’

‘তোমার বাবা-মা কলকাতায় তোমার মামাবাড়ি এসেছেন, একথা তাহলে সত্যি নয়?’

‘না স্যার।’

‘দেশেই রয়েছেন তাঁরা? তোমার বাবা-মা?’

‘না স্যার।’

‘তাহলে এখন কোথায় আছেন তাঁরা?’

‘কোত্থাও না।’

‘কোত্থাও না! তার মানে?’

‘বাবা-মা আমার নেইকো, সার! মারা গেছেন ছোটোবেলায়।’ বলেই সঠিক সত্য বলা হল না মনে করে রতন আবার চট করে তার মানে করে, ‘মানে, বাবা-মার ছোটোবেলায় মারা যাননি স্যার—আমার ছোটোবেলাতেই।’

রতনের এমন নিখুঁত সত্যপ্রিয়তা দেখে সত্যপ্রিয়বাবু খুশি না হয়ে পারেন না।

—‘ভালো কথা। খুব ভালো কথা। খুবই ভালো কথা।’

‘আমি চোখে দেখার আগেই তাঁরা—মানে, আমার বাবা-মারা চোখ বুজেছেন।’

‘বেশ! বেশ! শুনে সুখী হলাম!’ রতনের বাবার যথাযথ মৃত্যুসংবাদে তাঁকে উৎফুল্ল দেখা যায়—‘তাহলে তোমার মামাতো ভাই বিপিন—’

‘বিপিন বলে আমার কেউ নেই।’ বেফাঁস করে রতন।—‘বিপিনকে আমি চিনিনে।’

‘তবে যে বললে তোমার মামাতো ভাই? যে-হতভাগা কাজ করে বদ্যিবাটীতে। বদ্যিবাটীতে সেই ভুসিমালের কারখানায়—’

‘আমার মামাই নেই তো মামাতো ভাই!’ রতন ষোলো আনা অকপট।— ‘তা ছাড়া, স্যার, ভুসিমালের কারখানাও নেই বদ্যিবাটীতে।’

‘নেই? একদম না?’ সত্যপ্রিয়বাবু একটু যেন দমেন।

‘না, স্যার। কারখানাও নেই, তার কোনো মালিকও না।’ বলতে বলতে, সত্য বলার জিঘাংসা যেন ওকে পেয়ে বসে, বেপরোয়া সেসত্য বলে—সত্যবাবুর মুখের ওপরেই বলে যায়—‘আপনি—আপনি, স্যার, মিথ্যেকথা বলেছেন। আপনিও। বদ্যিবাটীতে যানইনি আপনি!’

‘তুমি—তুমি দূর হও আমার সামনে থেকে।’

‘আপনি আমায় ক্ষমা করুন স্যার। আমি এখুনি হেডমাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে সব কথা বলে তাঁর কাছে মাপ চাইব। সমস্ত কথা খুলে বলব তাঁকে। ভুসিমাল থেকে ভুসির মালিক কিচ্ছু গোপন করব না। আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন, স্যার। সত্যকথাই শে-শে-শ্রেয়। জীবনে আর আমি একটাও মিথ্যে বলব না। কখনো নয়—কক্ষনো না—’

সত্যকথা বলতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে রতন। সত্যবাদিতার ভূতে পেয়েছে ওকে। সত্যনিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা রতনকে দেখে, সত্যপ্রিয়বাবুর সত্যি সত্যিই বুঝি ভয় করে।

‘না, রতন, যেয়ো না—লক্ষ্মীটি। হেডমাস্টারমশায়ের কাছে যাওয়ার তোমার দরকার নেই। তাঁর কাছে গিয়ে কিচ্ছু তোমায় বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। এই নাও—শনিবারের চ্যারিটি ম্যাচের আমার এই টিকিটখানা নাও তুমি। সাদা গ্যালারির টিকিট। ইশকুলের ছুটি না পেলেও তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। শনিবারের হাফ-হলিডের পর জলটল খেয়ে এখান থেকে রওনা হলেই চলবে। সাদা গ্যালারিতে খেলা আরম্ভর আধ ঘণ্টা আগে গিয়ে ঢুকলেই হয়। এই নাও, আরও এক টাকা—তোমার জলখাবারের জন্য।’

‘আপনি যাবেন না, স্যার, দেখতে?’

‘না। শনিবার দিন আমার যাওয়া হবে না। সেদিন আমার শরীর ভারি খারাপ করবে।’

‘তাহলে না যান, শরীর নেহাত খারাপ হলে গিয়ে কাজ নেই, স্যার। আমি বরং ফিরে এসে খেলার সব খবর বলব আপনাকে। গোড়ার থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত—একেবারে ঠিক ঠিক। একটুও না-মিথ্যে করে—না বানিয়ে—না বাড়িয়ে। হ্যাঁ, স্যার।’

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments