শিক্ষণীয় গল্প – ভাঙা পাত্রের উপহার
অনেক অনেক দিন আগের কথা। পাহাড়ের কোলে একটা ছোট্ট গ্রামে এক দরিদ্র লোক বাস করত। সে ছিল একজন পানি বহনকারী। তার কাজ ছিল নদী থেকে পানি এনে গ্রামের লোকদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। সে প্রতিদিন সকালে নদীতে যেত, পানি তুলত আর দুইটি বড় পাত্রে ভরে কাঁধে লাঠিতে ঝুলিয়ে বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দিত।
লোকটির ছিল দুটি মাটির পাত্র। এক পাত্র একেবারে ঠিকঠাক ছিল মজবুত, শক্ত আর সুন্দর। আরেকটি পাত্র ছিল একটু ভাঙা, তার পাশে একটা ছোট ফাটল ছিল।
প্রতিদিন, যখন লোকটি পানি ভরে কাঁধে তুলে পথ হাঁটত, তখন ভাঙা পাত্রটি থেকে পানি আস্তে আস্তে ফুঁট ফুঁট করে গড়িয়ে পড়ে যেত। ধীরে ধীরে সেই পাত্রটি অর্ধেক খালি হয়ে যেত। ফলে প্রতিদিন লোকটি তার গন্তব্যে এক পাত্র আর অর্ধেক পানি, মানে দেড় পাত্র পানি নিয়ে পৌঁছাত।
ভালো পাত্রটি খুবই গর্বিত ছিল। সে ভাবত, “আমি ঠিকঠাক কাজ করছি! প্রতিদিন পুরো এক পাত্র পানি পৌঁছে দিচ্ছি। আমি কত ভালো!”
কিন্তু ভাঙা পাত্রটি দুঃখে ভেঙে পড়ত। সে মনে করত, “আমি তো ব্যর্থ। আমাকে দিয়ে তো কাজই হয় না। আমি তো অর্ধেক পানি ফেলে দিই!”
এভাবে দিন যায়, মাস যায়। একদিন ভাঙা পাত্রটি আর চুপ থাকতে পারল না। সে লোকটির সঙ্গে কথা বলল।
– “আমাকে ক্ষমা করো, আমি খুব লজ্জিত,” ভাঙা পাত্রটি বলল।
– “কেন গো, তুমি লজ্জিত কেন?” লোকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
– “তুমি প্রতিদিন এত কষ্ট করে আমাকে পানি দিয়ে পূর্ণ করো। কিন্তু আমি তো পথে আসতে আসতে অর্ধেক পানি ফেলে দিই। আমি তোমার উপকার করতে পারি না। আমি একটা ত্রুটিপূর্ণ পাত্র!”
লোকটি মুচকি হেসে বলল, “তুমি জানো, আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম তোমার একটা ছোট ফাটল আছে। কিন্তু আমি সেটাকে কখনো খারাপভাবে নেইনি। বরং আমি সেটাকে কাজে লাগিয়েছি।”
ভাঙা পাত্রটি অবাক হয়ে বলল, “মানে? আমি তো শুধু পানি ফেলেছি!”
লোকটি তখন পাত্রটিকে বলল, “আসো, আজ ফিরতি পথে আমি তোমাকে কিছু দেখাই।”
লোকটি আবার নদীতে গিয়ে পানি ভরে ফিরতে লাগল। পথে সে পাত্রটিকে বলল, “দেখো, যে দিক দিয়ে তুমি ঝর ঝর করে পানি ফেল, ঠিক সে পাশের পথঘাটে কত সুন্দর ফুল ফুটেছে! লাল, হলুদ, নীল, গোলাপি, কী রঙিন আর সুন্দর! এই ফুলগুলো কিন্তু তোমার জন্যই ফুটেছে।”
ভাঙা পাত্রটি চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সত্যি! পথের এক পাশ ফুলে ফুলে ভরা। সেগুলো বাতাসে দুলছে, পাখিরা গান গাইছে আর প্রজাপতিরা ওড়ে বেড়াচ্ছে।
অপরদিকে, ভালো পাত্রের পাশের পথ একেবারে ফাঁকা, ধুলো আর পাথর ছাড়া কিছুই নেই।
লোকটি হেসে বলল, “তোমার ফাটল দিয়ে যে পানি গড়িয়ে যেত, সেটা আমি কাজে লাগিয়েছি। আমি সেই পাশে ফুলের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর তুমি প্রতিদিন পানি দিয়ে তাদের বড় করেছো। এখন দেখো, সেই পথটা কত সুন্দর।”
ভাঙা পাত্রটির চোখে আনন্দের জল এসে গেল। সে ভাবল, “আমি তো ভেবেছিলাম আমি কোনো কাজের নই। কিন্তু আমার মধ্যেই ছিল এক বিশেষ উপহার।”