Tuesday, May 13, 2025
Homeভৌতিক গল্পঠিক সন্ধে নামার পরে

ঠিক সন্ধে নামার পরে

ঠিক সন্ধে নামার পরে

ট্রেনে উঠলে দারুণ ঘুম হয় আমার। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কখন যে গন্তব্যে চলে আসি, টের পাই না। এবারও ঘুম ভাঙল শ্রীমঙ্গলে এসে। কমলাপুর থেকে সকালের ট্রেনে রওনা দিয়েছিলাম। কথা ছিল, দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু টঙ্গীতে এসে প্রায় চার ঘণ্টা বসে থাকতে হলো, কোনো এক মালবাহী ট্রেনের নাকি বগি উল্টে গেছে! তাই পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে বিকেল।

একটা চাকরিতে যোগ দিতে শ্রীমঙ্গলে এসেছি। অনার্স পাস করে বহুদিন বেকার ছিলাম। বন্ধুর বাবার সুপারিশে এই সোনার হরিণ চাকরি পাওয়া গেল। একটি চা-বাগানে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে হবে।

আমি ঢাকার ছেলে। জন্ম, পড়াশোনা, আত্মীয়স্বজন—সবই ঢাকায়। ঢাকার বাইরেও যাইনি কখনো। কিন্তু কত দিন আর বেকার থাকা যায়! খানিকটা বাধ্য হয়েই আমার শ্রীমঙ্গলে আসা। এসেই পড়েছি মহা মুশকিলে। আমাকে নিতে আসা চা-বাগানের গাড়িটা ফিরে গেছে। এখন আমাকে একা একাই যেতে হবে সেখানে।

স্টেশনে নেমে প্রথমে খুঁজে বের করলাম একটা চায়ের দোকান। ঘুম ঘুম ভাবটা কাটানো দরকার। কেউ যখন অপেক্ষা করে নেই, তখন এক কাপ চা খেয়ে শরীরটা চাঙা করে নেওয়া যাক। আদা-লেবু মেশানো কড়া লিকারের চা খেয়ে বের হয়ে গেলাম।

শেষ বিকেলের সূর্য তখন আরও হেলে পড়েছে। আমাকে যেতে হবে শহর থেকে অনেকটা দূরে, বর্ডারের কাছে। চা-বাগানটা সেখানেই। জিপ, সিএনজি দুটিই যায়। দেরি না করে তাই একটা সিএনজি ভাড়া করার চেষ্টা করলাম। একে তো অনেক দূরের পথ, আবার সূর্যও প্রায় ডোবার পথে। কেউ রাজি হতে চান না। অনেক অনুরোধের পর এক বুড়ো চাচাকে আড়াই গুণ ভাড়ায় মানাতে পারলাম।

সঙ্গে দুটি লাগেজ আর কাঁধের একটা ব্যাগ। সবকিছু নিয়ে সিএনজিতে উঠতেই চোখ লেগে এল আমার। চা খেয়েও লাভ হয়নি, ট্রেনের অসম্পূর্ণ ঘুম জেঁকে বসল।

ঘুম যখন পাতলা হলো, ঘোলা ঘোলা দৃষ্টিতে টের পেলাম, শহরের রাস্তা ছেড়ে আমরা ঢুকে পড়েছি চা-বাগানের রাজ্যে। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে চা-গাছের সমারোহ। বিশাল-সুবিশাল জায়গা নিয়ে গাছগুলো গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। হাতঘড়ি দেখে বুঝলাম, প্রায় আধঘণ্টা পার হয়েছে। আলো কমে এসেছে, সূর্যও চোখের আড়ালে।

সিএনজির চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কত দূর চাচা?’

‘এখনো অনেক দূর বাবা। ধরেন চার ভাগের তিন ভাগ বাকি।’

সিএনজিতে করে এত লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া আগে কখনো হয়নি। ঘণ্টার হিসাবে তিন ঘণ্টাও বসে থেকেছি, কিন্তু সেটা ওই ঢাকার জ্যামে। ঢাকার কথা মনে পড়তেই টের পেলাম, বাড়ি ছেড়ে কত দূরে চলে এসেছি। সাহস করে দূরের এক উপজেলায় চলে এসেছি একা একা। প্রথমবারের মতো নিজেকে বেশ বড় মনে হতে লাগল। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চা-বাগানের মধ্য দিয়ে ধুলা উড়িয়ে ছুটে যাওয়ার একটা আলাদা রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলাম।

সব ঠিকই ছিল, বিপত্তি বাধল একটা মোড়ে এসে। রাস্তা ভাগ হয়ে দুই দিকে চলে গেছে। কিন্তু কোনটা ধরে এগোতে হবে, সেটা জানেন না সিএনজির চাচা। অনেক আগে একবার এসেছিলেন, এখন মনে করতে পারছেন না।

ঝুপ করে অন্ধকার নেমে গেছে। আশপাশে কোথাও কোনো লাইটের ব্যবস্থা নেই, নেই রোড লাইটও! মানুষের নামগন্ধ তো দূরে থাক! সিএনজির হেডলাইটের আলোয় বোঝার চেষ্টা করলাম, কোন পথটা নেওয়া উচিত। কিন্তু এমন কোনো চিহ্ন বা সূত্র চোখে পড়ছে না, যেটার লেজ ধরে কিছু একটা আন্দাজ করা যাবে।

মিনিট দশেক ধরে এক জায়গায় থেমে আছি। সিএনজির চাচা যে ঠিকভাবে পথ চেনেন না, সেটা জানলে হয়তো অন্য ব্যবস্থা করতাম। নেটওয়ার্কও নেই যে গুগল ম্যাপে ঢুকে দেখে নেওয়া যাবে। ভালো একটা বোকামি হয়েছে! চাচার চেয়ে নিজের ওপরেই বেশি মেজাজ খারাপ হতে লাগল।

সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকে আকাশে মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। এদিকে যে বলা-কওয়া ছাড়া বৃষ্টি হয়, সেটা বইয়ে পড়েছি। এখন মনে হচ্ছে, বাস্তবেও দেখতে হবে। নাহ্‌! আর দেরি করা যাবে না।

অনেকটা ‘যা আছে কপালে’ মন্ত্রের ওপর ভরসা করে চাচাকে বললাম, বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগোতে। আবার রওনা দিলাম।

মেঘ হওয়ার পর থেকে একেবারে রাতের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে গেছে। সন্ধ্যার আবছা আলোটাও আর দেখা যাচ্ছে না। এমন অন্ধকার কোনো শহরে কখনো দেখিনি! রোমাঞ্চের আমেজ আর নেই। সিএনজির ভেতরে বসেও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কোনোভাবে চা-বাগানটায় পৌঁছালে হয়!

মন আমার কুডাক দিচ্ছে। সকালে ট্রেনের লেট থেকে শুরু, স্টেশনে নেমে গাড়ি মিস হওয়া, বাড়তি ভাড়ায় এসেও দেখা যাচ্ছে সিএনজিওয়ালা পথ চেনে না! শেষে দেখা যাবে এটাও ভুল পথ, ফিরে এসে আবার যেতে হবে আগের পথে।

কিন্তু ভুল পথ কি না, বোঝার আগেই জোর ব্রেক করে থেমে গেল সিএনজি।

‘কী হলো, চাচা?’

‘সামনে কাঠের ব্রিজ ভাঙা।’

‘তাইলে এখন?’

‘আপনে বলেন…’

মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। পথ না চিনে অচেনা এক এলাকায় এনে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কোনটা করণীয়?

সিএনজি থেকে নেমে ব্রিজের অবস্থা বোঝার জন্য এগোলাম। চারপাশের চা-বাগানকে এই অন্ধকারে জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো জনবসতি নেই।

কাঠের ব্রিজ, এক পাশের অর্ধেক কাঠ ভেঙে পড়ে আছে। বাকি অর্ধেক দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। হয়তো সাইকেল নিয়েও যাওয়া যায়, কিন্তু সিএনজি ওঠানো খুবই বিপজ্জনক। কাঠের যা অবস্থা, তাতে ভার নিতে পারবে কি না, বলা যাচ্ছে না।

মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। তার মানে এই রাস্তা দিয়ে গাড়িও যেতে পারবে না! চা-বাগানের গাড়ি…এটা ভুল রাস্তা।

সিএনজির কাছে ফিরে এলাম। খুশি আর উত্তেজনায় চাচাকে বললাম, ‘এইটা ভুল রাস্তা চাচা। গাড়ি তো যেতে পারবে না এদিক দিয়ে! তার মানে ওই রাস্তাটাই…’

চাচা আমারে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইটা বলা যায় না বাবা। এই দিকেও তো চা-বাগান থাকার কথা। অনেক সময় গাড়ি এই পর্যন্তই আসে, ওই পাশ থেইকা ট্রাক্টর গাড়ি নাইলে ভ্যানগাড়িতে কইরা আগায় নেয় বাকিটা।’

আমার ১০০ ওয়াটের মতো জ্বলে থাকা মুখটা নিভে গেল। এবার তাহলে কী করব?

বললাম, ‘চাচা আপনি আমারে ফিরায়ে নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে আগায় দেন।’

‘কিন্তু বাবা…। গাড়িতে তো গ্যাস বেশি নাই! এতটা পথ ফিরে ওই রাস্তায় গেলে আমার আর শহরে যাওয়া হইব না। মাঝখানে গ্যাস ফুরায় যাইব।’

এ কী যন্ত্রণা! আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু এটাকেই কি শনির দশা বলে? একসঙ্গে এতগুলো অনুভূতি যাচ্ছে যে কেমন লাগছে, সেটা বুঝতে পারছি না।

‘কী করব তাইলে চাচা?’

‘আপনে এক কাজ করেন। একটু হাঁটতে পারেন, আগাইলে হয়তো কোনো এক বাগানে ঢুইকা পড়তে পারবেন। সিকিউরিটিরে বললে আপনারে একটা রাত থাকার ব্যবস্থা কইরা দিব। তারপর সকালে নাহয়…’

চাচার বুদ্ধি পছন্দ হলো না। আমাকে এই বিপদে ফেলে কেটে পড়তে চাচ্ছেন। সত্যি সত্যি গাড়িতে গ্যাস কম কি না, কে জানে! কিন্তু ঝামেলা যে করব, সেই সাহসও হচ্ছে না। তার চেয়ে নেগোসিয়েশন করা যাক।

‘আরেকটা কাজ করা যায়। আপনি একটু আমারে আগায়ে দিলেন। গাড়ি এইখানেই থাকল না হয়, এত রাতে কে আর নেবে! আপনি আমারে আগায়ে দিয়ে ফিরে এসে শহরে চলে গেলেন…কী বলেন?’

প্রস্তাবটা যে চাচার মনে ধরেনি, বুঝলাম হ্যাঁ-না কোনো কিছু না বলায়। চুপচাপ গাড়ি থেকে আমার মালপত্র নামালেন। মনে হয় মানবতার খাতিরেই হেঁটে চললেন আমার পেছনে।

টিলা কেটে বের করা শক্ত মাটির পথ। সবকিছু নীরব। অন্ধকার। এত গাঢ় অন্ধকার যে ফ্ল্যাশলাইটের আলোতেও নিজের পা দেখা যাচ্ছে না। মোড় ঘুরে ফেলায় সিএনজির হেডলাইটও আড়াল হয়ে গেছে। কেবল আমরা দুজন হেঁটে চলেছি। চাচার মুখে একটা শব্দও নেই।

অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা আলো চোখে পড়ল। চা-বাগানের ভেতর দিয়ে দূরে একটা টিলায় আলো জ্বলছে। একটা ঘরের অবয়বও বোঝা যাচ্ছে। এতক্ষণে চাচার মুখে কথা ফুটল।

‘ওই যে! ওইখানে যান। রাতটা ওইখানেই থাকেন। সকাল হইলে…’

গুমোট ভাব কেটে যাওয়ায় হেসে ফেললাম, ‘ঠিক আছে, চাচা। অনেক কষ্ট করলেন।’

‘না, ঠিক আছে…তাইলে আমি যাই!’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছেন, আমার আর জোরাজুরি করতে ইচ্ছা হলো না। এটুকু আমিই যেতে পারব। ভাড়ার সঙ্গে আরও ১০০ টাকা বকশিশ দিয়ে তাঁকে বিদায় করলাম।

এবার দুই হাতে দুটি লাগেজ নিয়ে একা একাই এগিয়ে যেতে হবে চা-বাগানের ভেতরের পথ দিয়ে। ফ্ল্যাশলাইট ধরে থাকার উপায় নেই। মাটির রাস্তা ছেড়ে চা-বাগানের গলির মতো সরু পথে ঢুকে পড়লাম। অনেকটা আন্দাজ করে এগোতে হবে এখন।

দিনের বেলা হলে কিছুটা সুবিধা হতো। কিন্তু এই কুচকুচে কালো অন্ধকারে কোথায় গলির শেষ, কোথায় গলির বাঁক, কিচ্ছু বোঝার কায়দা নেই। যেখানে গিয়ে আটকে যাই, ডানে-বাঁয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

১৫ মিনিট…২০ মিনিট…আধঘণ্টা, এমনকি ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। কিন্তু টিলার ওপরে থাকা আলোর উৎস যেন বহুদূর! কিছুতেই কাছাকাছি যেতে পারছি না। ঘেমে-নেয়ে একাকার। শুরুতে যে উৎসাহ ছিল, এখন সব পানি হয়ে গেছে।

মনে হচ্ছে, এটা চা-বাগান নয়, একটা ডেডলক। বের হওয়ার যেন রাস্তা নেই! এগুলো ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কখন যে ভয় এসে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে, জানি না। কী করব, কোন দিকে যাব—কিচ্ছু চিন্তা করতে পারছি না। চিন্তাশক্তি লোপ পেতে শুরু করেছে।

লাগেজ দুটি নামিয়ে রাখলাম। এগুলো টানতে গিয়ে আরও বেশি ক্লান্ত হচ্ছি। মোবাইলে খুব বেশি চার্জ নেই, তা-ও ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে এগোতে শুরু করলাম।

এক পা, দুই পা, তিন পা এগিয়ে সামনে মোড় নিয়েছি। পায়ের সঙ্গে কী যেন একটা বাঁধল। আলো ফেলতে দেখি, এক জোড়া পা, কেউ পড়ে আছে এখানে! নিচু হয়ে ভালো করে আলো ধরতেই আমার মুখ থেকে একটা চিৎকার বের হয়ে গেল।

‘চাচা!’

চোখ দুটো খোলা। কিন্তু অবিচল। পলক পড়ছে না। নিশ্বাসও চলছে না। আমাকে এগিয়ে দিতে আসা সিএনজির ড্রাইভার চাচা এখানে মরে পড়ে আছেন। এখানে? কীভাবে?

আমার মাথা তখন ঝিমঝিম করছে। আর কত ধকল নেবে? আমি বসে থাকা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। সর্বশক্তি দিয়ে যখন দাঁড়িয়েছি, তখনই মাথাটা ঘুরে উঠল। হাঁটুর শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়লাম।

পরদিন সূর্য ওঠার পর, কোলাহলে আমার জ্ঞান ফিরল। মুখের সামনে একঝাঁক অচেনা মুখ। ছোট্ট একটা চৌকিতে শুয়ে আছি। যাঁরা ঘিরে আছেন, তাঁদের চা-বাগানের শ্রমিক বলেই মনে হলো। কেবল শার্ট-প্যান্ট পরা একজন চৌকির কাছে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন।

উঠে বসার চেষ্টা করলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে শার্ট পরা মধ্যবয়স্ক লোকটি বললেন, ‘ব্যস্ত হবেন না। শুয়েই থাকুন। আপনার ভাগ্য খুব ভালো।’

আস্তে আস্তে বললাম, ‘কী হয়েছিল আমার?’

‘জ্ঞান হারিয়েছিলেন বোধ হয়। ওয়ার্কাররা ভোরে কাজ করতে গিয়ে আপনাকে খুঁজে পায়।’

একটা সূত্র পেলে যেকোনো কিছু সহজে মনে আসতে থাকে। আমারও একে একে সব মনে পড়তে লাগল।

বললাম, ‘আমার সঙ্গে…আরেকজন…’

‘সরি। উনাকে আমরা আপনার মতো পাইনি, উনি আগেই…আপনারা কেন ঢুকেছিলেন এদিকে?’

সংক্ষেপে যতটা পারলাম, খুলে বললাম। সব শুনে আবারও বললেন, ‘আপনি সত্যিই খুব ভাগ্যবান।’

ভাবলাম, বেঁচে আছি বলেই বোধ হয় বলছেন। তবু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’

বললেন, ‘সন্ধ্যার পর এই চা-বাগানে কেউ ঢোকে না। না পারলে পথও মাড়ায় না। আমরা যা যা প্রয়োজন, সব সেরে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসি বাংলোতে। ওয়ার্কাররা তো বিকেল চারটের পর থেকেই চলে যেতে শুরু করে, পাঁচটা বাজার আগে একেবারে ফাঁকা…’

একটু থামলেন, আবার বলা শুরু করলেন, ‘এটা তো এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো চা-বাগানগুলোর মধ্যে একটা। সেই শুরুর সময় থেকেই, অন্ধকার হলে কেউ পথ খুঁজে পায় না। দিনের বেলা হাতের রেখার মতো চেনে যে ওয়ার্কার, তার কাছেও সন্ধ্যার পর এটা গোলকধাঁধা। অনেকেই আপনার মতো দূরের টিলায় আলো দেখে। আসলে ওখানে কিছুই নেই! সন্ধ্যার পর যারা পথ হারায়, তাদের মধ্যে কারও ভাগ্যই আপনার মতো সুপ্রসন্ন না। অন্তত দশজনের নাম তো আমিই জানি। পরদিন চা-বাগানের মধ্যে মৃত পাওয়া গেছে। এর আগেও যে কতজন মারা গেছে, সেটার হিসাব নেই।’

‘কিন্তু মারা যাওয়ার কারণ?’

‘বেশির ভাগই…যেভাবে আপনার সিএনজিওয়ালা মারা গেছেন, সেভাবে…সাপের কামড়ে। টু বি স্পেসিফিক, কেউটের কামড়ে। আর দু-একজন আপনার মতো, ভয় পেয়ে। আপনারও পালস পাচ্ছিলাম না ঠিকমতো…’

‘চাচাকে সাপে কেটেছে? কেউটে? এত দিনেও আপনারা সাপ ধরার ব্যবস্থা নিতে পারেননি?’

লোকটা কিছু বললেন না। মাথা নিচু করলেন। পাশ থেকে রোদে পোড়া শুকনো দেহের একজন বললেন, ‘চেষ্টা তো অনেক করছে। বড় স্যাররা, আমরা, সবাই। কিন্তু স্যার, অশরীরীরে ধরব কেমন করে?’

মাথা নাড়িয়ে ম্যানেজার গোছের লোকটা আবার বললেন, ‘আসলে চেষ্টার কমতি করিনি। কিন্তু কোনো সাপ পাওয়া যায়নি। কেউটে তো দূর, ঢোড়া সাপের দেখাও মেলেনি। অথচ লাশের পায়ে ঠিকই সাপের দাঁতের চিহ্ন থাকে। পোস্টমর্টেম করে সাপের বিষেই মৃত্যু, টু বি স্পেসিফিক কেউটের কামড়ে মৃত্যু পাওয়া যায়।’

আমার মাথা আবার ভনভন করতে শুরু করল। মনের মধ্যে জ্ঞান হারানোর আগে যে প্রশ্নটা ঘুরছিল, সেটা আবারও ঘুরপাক খাচ্ছে। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ফেলে বললাম, ‘কিন্তু চাচাকে তো আমি বিদায় দিয়ে আসছিলাম, উনি কীভাবে…’

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জবাব এল, ‘বোধ হয় ওই অন্ধকারে আপনাকে একা ছেড়ে যেতে চাননি। কিছু দূর গিয়েই হয়তো ফিরে এসেছিলেন…হয়তো বিপদে পড়তে পারেন ভেবে…হয়তো মায়ার জন্যে…কিংবা পথ হারিয়েছিলেন…’

তা–ই-ই হবে! আর কোনো প্রশ্ন আসছে না। চোখ বন্ধ করলাম। নাহ্‌, চা-বাগানের চাকরি আমাকে দিয়ে হবে না। এই গোলকধাঁধায় প্রাণ দেওয়ার চাইতে আরও কিছুদিন বেকার থাকা ঢের ভালো।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments