Tuesday, June 17, 2025
Homeমজার গল্পটুনি মেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

টুনি মেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

টুনি মেম – সৈয়দ মুজতবা আলী

বেশি দিনের কথা নয়, হালের। পড়িমড়ি হয়ে শেয়ালদায় আসাম লিঙ্কে উঠেছি। বোলপুরে নাবব। কামরা ফাঁকা। এককোণে গলকম্বল মানমুনিয়া দাড়িওয়ালা একটি সুদর্শন ভদ্রলোক মাত্র। তিনি আমার দিকে আড়নয়নে তাকান, আম্মো।

একসঙ্গেই একে অন্যকে চিনতে পারলুম।

আমি বললুম, খান না রে?

সে হাকল, মিতু না রে?

যুগপৎ উল্লম্ফন, ঘন ঘন আলিঙ্গন। পাঠশালে পাশাপাশি বসতুম। তার পর এই তিরিশটি বছর পরে দেখা। প্রথম উচ্ছ্বাস সমাপ্ত হলে জিগ্যেস করলুম, তুই এ রকম বদখদ দড়ি-দাঁড়া রেখেছিস কেন?

খানটা ওই পাঠশালার যুগেও ছিল হাড়ে টক শয়তান। প্রশ্ন শুধালে ইহুদিদের মতো পাল্টা প্রশ্ন জিগ্যেস করে, উত্তরটা এড়িয়ে যায়। শুধাল, দাঁড়া কারে কয়?

হাঁড়ি বড় সাইজের হলে হাঁড়া হয়, গাড়ি গাড়া। দাড়ি হিন্দি-উর্দুতে স্ত্রীলিঙ্গ!–কিন্তু দাঁড়া পুংলিঙ্গ। তোরটা দাড়ি নয়, দাঁড়া।

অবশ্য অস্বীকার করিনে, তাকে দেখাচ্ছিল গত শতাব্দীর ফরাসি খানদানিদের মতো। খানের রঙ প্যাটপেটে ফর্সা। গায়ে প্রচুর পাঁঠার রক্ত। শুধালুম, তা তোর পাকিস্তান ছেড়ে এই না-পাক দেশে এসেছিস কী করতে?

আজমিরের খাজা মুঈন-উদ-দীন চিশতির কাছে মানত করেছিলুম, বাবার আশীর্বাদে আল্লা যদি আমাকে এসৃপি-তে প্রোমোশন করেন তবে বাবার দরগা দর্শনে যাব, ভালো-মন্দ যা আছে তাই দিয়ে শিরনি চড়াব। সেই সেরে ফিরছি। এই নে প্রসাদি-গোলাপের পাপড়ি।

আমি মাথায় ছুঁয়ে বললুম, ও! তুই বুঝি পুলিশে ঢুকেছিলি?

বলল, হ্যাঁ, সাব-ইন্সপেকটর হয়ে।

আশ্চর্য হয়ে শুধালুম, বলিস কী রে? আর এরই মধ্যে এসপি।

প্রসাদির পাপড়ি মাথায় ঠেকিয়ে বলল, খাজা মুঈন-উদ-দীন চিশতির দোওয়া আর হিন্দুদের কৃপায়!

হিন্দুদের কৃপায়!

হ্যাঁ ভাই, তেনাদেরই কেরপায়। তেনারা যদি পূর্ব বাঙলার পুলিশের ডাঙর ডাঙর নোকরি ছেড়ে ঝেঁটিয়ে পশ্চিম বাঙলা আর আসামে না চলে যেতেন তা হলে আমি গণ্ডায় গণ্ডায় প্রমোশন পেতুম কী করে? তারা থাকলে হয়তো অবিচার করে আমাকে দু একটা না-হক প্রোমোশন দিত, কিন্তু একদম দিনকে রাত, রাতকে দিন তো করা যায় না। আর তুই তো বিশ্বাস করবিনে– তুই চিরকালই সন্দেহপিচাশ, যে কটি হিন্দু রয়ে গেল তারা গণ্ডায় গণ্ডায় না হোক জোড়ায় জোড়ায় প্রোমোশন পেয়েছে। জানিস, মণ্ডল সিভিল সার্জন হয়েছে?

আমি ভিরমি যাই আর কি। গাড়ল ফোঁড়াটি পর্যন্ত কাটতে জানত না।

খান বলল, সব তো শুনলি। তোর বইও আমি দু চারখানা পড়েছি। আচ্ছা বল তো, এসব বানিয়ে বানিয়ে লিখিস, না কিছু কিছু দেখা-শোনার জিনিস, অভিজ্ঞতার বস্তু?

কিছুটা বানিয়ে, কিছুটা অভিজ্ঞতা থেকে।

তাজ্জব! অমি তো ভাই বিস্তর খুন-খারাবি দেখলুম। এক-একটা এমন যে, আস্ত একখানা উপন্যাস হয়। কিন্তু তারই রিপোর্ট লিখতে গেলে আমার তালুর জল আর নিবের কালি শুকিয়ে যায়। কী করে যে তুই লিখিস।

আমি বললুম, আমাকেও যদি সুদ্ধমাত্র ফ্যাক্টের ভিতর নিজেকে সীমাবদ্ধ করে লিখতে হত তা হলে আমার রিপোর্টটা হত তোর চেয়েও ওঁচা। কল্পনা এসে উৎপাত করত। তা সেকথা যা গো আমার দিনকাল বড্ডই খারাপ যাচ্ছে প্লটের অপর্যাপ্ত অনটন। সম্পাদক মিঞা আবার গল্পই চান, ইলসট্রেট করবেন। বল না একটা।

দাড়ির ভিতর দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, কোনটা বলি, কেসগুলো তো মাথার ভিতর আবজাব করছে। আচ্ছা দাঁড়া, ভেবে নিই।

এমন সময় সিগনেল অভাবে ট্রেন খামোকা মাঝপথে দাঁড়াল। খান বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, এরা কী জাত রে?

তাকিয়ে দেখি, মিশকালো সাঁওতাল মেয়ে তার ওপর মেখেছে প্রচুর তেল। শাড়ির উপর বেঁধেছে গামছা, উত্তমাঙ্গে চোলিফোলি কিছু নেই, নিটোল দেহ, সুডোল ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষেরটা বোঝা গেল পরিষ্কার, কারণ, হাতদুটি যতদূর সম্ভব উঁচু করে পলাশ ফুল পাড়বার চেষ্টা করছিল খোঁপায় গুজবে বলে। হলদে পলাশ। এ অঞ্চলে লালের তুলনায় ঢের কম। কী জানি, মেয়েটা হয়তো ভেবেছে, লাল-কালোর চাইতে হলদে-কালোর কন্ট্রাস্টে খোলতাই বেশি।

বললম, সাঁওতাল। হ্যাঁ, আমাদের দেশে অতদুর ওরা পৌঁছয়নি। কিংবা হয়তো ছিল এককালে। কাল যে-রকম হিন্দু পুব বাঙলা ছেড়ে চলে এল, এরা হয়তো পরশু।

খান দেখি, আমার কথায় বিশেষ কান দিচ্ছে না। আপন মনে কী যেন ভাবছে। ওস্তাদ গাওয়াইয়া যে-রকম গান শুরু করার পূর্বে হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে যান। তখন বিরক্ত করতে নেই।

গাড়ি ছাড়ল। একটু কাছে এসে বলল, ওই কালো মেয়ে আরেকটি মেয়ের কথা আমার স্মরণে এনে দিল। তার রঙ ছিল এর চেয়েও কালো। কিন্তু সে কী কালো! সব রঙের অভাবে নাকি কালো হয়! হ্যাঁ তাই; কোনও রঙই সাহস করে তার শরীর চড়াও করতে পারেনি। আমি তাকে দেখেছিলুম তার শারীরিক মানসিক চরম দুরবস্থায়। তবু চোখ ফেরাতে পারিনি। হিন্দুরা কেন যে কালী কালী করে তখন বুঝতে পেরেছিলুম।

গাড়ি বর্ধমানে এসে থামল। বর্ধমানে আমি গত সাত বছর ধরে অর্ডার দিয়ে কখনও কেলনারের কাছ থেকে চা-আণ্ডা পাইনি। কাজেই ফর সেফটিস সেক প্রথমেই ভাঁড়ের চা কিনে রাখলুম। বিস্তর ছুটোছুটি করে কিছু-কিঞ্চিতের জোগাড় হল। স্থির করলুম, বোলপুরে খানকে একটা পুরা পাক্কা খানা তুলে দেব। সেখানকার গোসাই আমাকে নেকনজরে দেখে।

গাড়ি ছাড়তে খান বলল, আমি তখন আব্রুগড়ে। এসৃআই– আমরা বাঙলায় লিখি এছাই। রোজ থানায় বসে ভাবি, ইয়া আল্লা, চাকরির এ দুস্তর দরিয়া পেরিয়ে কবে গিয়ে এমন মোকামে পৌঁছব যেখানে হরহামেশা পয়সাটা-আধলাটার হিসাব না করতে হয়। ঘুষ খেতে তখনও শিখিনি–

আমি শুধালুম, এখন শিখেছিস? তা—

বললে, হ্যাঁ, তবে সে অন্য ধরনের। পরে তোকে বুঝিয়ে বলব।

আব্রুগড় বড় মনোরম জায়গা। অনেকটা শিলঙের মতো উঁচু-নিচুতে ভর্তি, টিলাটালার টক্কর। কোন্ এক সায়েব নাকি মালয় না, কোথা থেকে কৃষ্ণচূড়া এনে এখানে পুঁতে দেয়। এখন শহরটা আগাপাশতলা তাই দিয়ে ভর্তি। শহরটা এমনিতেই সবুজ, তার ওপর এল গোলমোরের কালো সবুজ আর তার মাঝখানে ফুটে ওঠে বাড়িগুলোর পোড়া লালের টাইলের ছাদ।

চতুর্দিকে অজস্র চা-বাগান আর তেলের খনি। সায়েব-সুবো, বেহারি-মারওয়াড়িতে শহরটা গিসগিস করছে। আর খাস আসামিদের তো কথাই নেই তারা বড়, বড় সরল। আব্রুগড়ের বটতলাতে চার আনা দিয়ে মিথ্যে সাক্ষী পাওয়া যেত না। আমাদের দেশে আকছারই যা যায়। এখন কী অবস্থা তা অবশ্য জানিনে।

বড়কর্তা বলেছিলেন, কিছু একটা জবরদস্ত নতুন না করতে পারলে কুইক প্রোমোশন হয় না। জবরদস্ত নতুন করবটাই-বা কী? এখানে খুন-খারাবি হয় অত্যল্প। উঠোনই নেই তো আমি নাচি কী করে!

তাই থানায় বসে বসে পুরনো দিনের খাতাপত্র দেখি, ফাইল পড়ি। সেইটেই একদিন লেগে গেল কাজে। পরে বলছি।

আমার চেনা এক রাজমিস্ত্রি আমায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে একদিন বলল, মোল্লাবাজারের পিছনে উঁচু টিলার উপর যে খালি বাঙলো আছে তার বাবুর্চিখানার ভিত মেরামত করতে গিয়ে সে একটা লাশ আবিষ্কার করেছে– ঠিক লাশ নয়, কঙ্কালই বলা যেতে পারে– পচা ছেঁড়া কম্বল জড়ানো।

রক্তের সন্ধান পেয়ে বললুম, তুমি ওখানে যাও। হঠাৎ যেন আবিষ্কার করেছ এই ভাব করে আমাকে খবর পাঠাও।

তা না হলে পরে প্রমাণ করতে হবে, ওটা সত্যই সেখানে ছিল, বাইরের থেকে এনে কেউ চাপায়নি।

জিনিসটা যে খারাবি, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাবুর্চিখানার নিচে কম্বলৈ জড়ানো পোঁতা কঙ্কাল! এখানে কস্মিনকালেও কোনও গোরস্তান ছিল না–টিলার ঢালুর দিকে কতটুকু জায়গা যে, ওখানে মানুষ গোরস্তান বানাতে যাবে। তা হলে এটা নিশ্চয়ই খুনের ব্যাপার। শুধু খারাবি নয়, খুন-খারাবি।

আমি বললুম, সাক্ষাৎ শার্লক হোমস।

শুধলে, সে আবার কে?

আমি প্রথমটায় হকচকিয়ে পরে সামলে নিয়ে বললুম, তুমি এগোও; আমি আর রসভঙ্গ করব না।

বলল, প্রথম রক্তের সন্ধান পেয়ে আমি যেন হন্যে হয়ে উঠলুম। সমস্ত রাত ঘুম হল না। মাথার ভিতর ঘুরছে, কত রকম নর-হত্যার ছবি, যেন স্বয়ং পাঁচকড়ি দে সেগুলো এঁকে যাচ্ছেন, আর দীনেন্দ্রকুমার রায় আপন হাতে রঙ গুলে দিচ্ছেন। বেবাক লালে লাল।

আমি বললুম, রসভঙ্গ করতে হল। অপরাধ নিসনি। হোমস্ হল বিলিতি অরিন্দম।

খান বলল, তাই বল। কিন্তু তুই ভাবিসনে, তোকে একটা রগরগে খুনের কাহিনী শোনাতে যাচ্ছি মাত্র। এতে আছে বড় দুঃখের কথা। বড় বিষাদ বেদনা। স্বর্গ আমি দেখিনি, কিন্তু স্বর্গচ্যুত হতভাগ্য একজনকে আমি দেখেছি। সে দৃশ্য আর কারও দেখবার দরকার নেই।

কী বলছিলুম? হ্যাঁ। ভোর হতে-না-হতেই আমি থানায় এসে উপস্থিত। কিন্তু মূর্খের মতো আমি রাজমিস্ত্রিকে বলে রাখিনি, সে কখন আসবে। সে যদি এসে ফিরে যায়; কিংবা কেসটা হাতছাড়া হয়ে যায়!

আজ হাসি পায়। রাতদুপুরে এখন যদি জমাদার এসে খবর দেয়, পদ্মার চরে ডাকাতিতে পাঁচটা চরুয়া আর তিনটে ডাকাত মারা গিয়েছে, আমি তা হলে পাশবালিশ জাবড়ে ধরে বলি, যা-যা, দি করিসনি!

রাজমিস্ত্রি হেলেদুলে বেলা প্রায় বারোটায় এলেন আমাকে আষ্ট ঘণ্টা দগ্ধানোর পর।

যেন সদ্য এইমাত্র ফার্স্ট ইনফর্মেশন পেয়েছি, এরকমধারা মুখের ভাব করে দুটি কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে অকুস্থলের দিকে রওনা দিলুম। গিয়ে দেখি অত্যন্ত কুস্থান, অর্থাৎ অকুস্থানই বটে।

আমি বললুম, ওই মলো। অকুস্থান হয়েছে আরবি, ওয়াকেয়া, অর্থাৎ ঘটনা আর স্থান নিয়ে।

খান বলল, থাক্ থাক্‌, আর বিদ্যে ফলাতে হবে না। অকুস্থলের হালটা ভালো করে শোন।

তিন বছর ধরে বাঙলোটায় বসতি ছিল না বলে বাবুর্চিখানার দোর-জানালা চুরি গিয়েছে, ঘরটা পড়ো-পড়ো। কে এক নতুন সাহেব আসবে বলে ওটার ভিত মেরামত করতে গিয়ে বেরিয়েছে একটা কঙ্কাল, পচা কম্বলে জড়ানো। মাথার চুল ছাড়া আর সব পচে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আমি নয়া শিকারির মতো সন্তর্পণে এগোলুম বলে খুলির ভিতর মাটির মধ্যে পেয়ে গেলুম একটা বুলেট– তখন ভালো করে তাকিয়ে দেখি, খুলির পিছনের দিকে একটা ওই সাইজের গর্ত।

আব্রুগড়ে গণ্ডায় গণ্ডায় স্পেশ্যালিস্ট নেই যে, আমায় তদ্দণ্ডেই বাৎলে দেবে, ব্যাপারটা কী, অন্তত এই যে কঙ্কাল, এর লাশটা কবে মাটিতে পোঁতা হয়েছিল। শহরের অ্যাসিস্টেন্ট সার্জন আমাদেরই জেলার ধীরেন সেন! তাঁকে ধরে এনে শুধালুম। বললেন, অন্তত তিন বছর। বিচক্ষণ লোক। রায়টা দিলেন কঙ্কাল উপেক্ষা করে, কম্বলটা উত্তমরূপে পরখ করে।

তা হলে প্রশ্ন, তিন বছর পূর্বে ওই বাঙলোয় থাকত কে– যার সময় ঘটনাটা ঘটেছিল?

খবর পাওয়া গেল, আইরিশম্যান পেট্রিক ও’হারা সাহেব। সে এখন কোথায়? জেলে। কেন? সে-কথা জেনে কি পুলি-পিঠের নেজ গজাবে?

আমার মন ক্ষণে এদিকে ধায়, ক্ষণে ওদিকে ধায়। বন্ধ ঘরে আগুন লাগলে মানুষ যেমন মতিচ্ছন্ন হয়ে ক্ষণে এ-দরজায়, ক্ষণে ও-জানালায় ধাক্কা দেয়– কোনও একটাও ভালো করে একাগ্রমনে খোলবার চেষ্টা করে না– আমার হল তাই। কোনও একটা ক্লু পাঁচ মিনিটের তরেও ঠিকমতো ফলোআপ করতে পারিনে।

এখন জ্ঞানগম্যি হয়েছে ঢের। এখন বুদ্ধি হয়েছে বলে বুঝেছি যে, এসব রহস্য সমাধান বুদ্ধির কর্ম নয়। রুটিনের ঘানিতে সবকিছু ফেলে দিতে হয়। তেল বেরিয়ে আসবেই আসবে, সমস্যা সমাধান হবেই হবে।

যে-কাজ আজ পাঁচ মিনিটে করতে পারি, তখন লেগেছিল এক হপ্তা। ততদিনে প্রশ্নগুলো মোটামুটি সামনে খাড়া করে নিয়েছি :

(১) লোকটা কে?

(২) এটা খুন তো?

(৩) কে খুন করল?

(৪) কার বন্দুকের গুলি?

কঙ্কাল থেকে মানুষ শনাক্ত অসম্ভব না হলেও বড়ই কঠিন। তন্ন তন্ন করেও আঙটি-টাঙটি, বাঁধানো দাঁত, ডেন্টিস্টের কোনও প্রকারের কেরানি কিছুই পাওয়া গেল না। ব্লাঙ্কো!

আমি তো এ শহরে এসেছি মাত্র কয়েক মাস হল, কিন্তু পুরনো বাসিন্দাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই কিছু না কিছু জানে, কিন্তু অহমিয়ারা সরল হলেও এ-তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানে যে, পুলিশের ঝামেলাতে খোদার খামোখা জড়িয়ে পড়তে নেই। ব্লাঙ্কো!

ইতিমধ্যে রিপোর্ট পৌঁছল, খুলির ভিতর যে বুলেট পাওয়া গিয়েছিল, সেই বুলেটই খুলির ফুটোটার জন্য দায়ী।

অমি বাঁকা হাসি হেসে বললুম, মারাত্মক আবিষ্কার। এ তো কানাও বলতে পারে। আর ওই দেখ, তোর কৃষ্ণসুন্দরী আর একপাল সাঁওতালি। ওদের বসতির দিকে এগোচ্ছি এখন।

গাড়ি তখন খানা জংশনে লুপ লাইনে ঢুকবে বলে ধীরে ধীরে চলছিল।

খান অনেকক্ষণ ধরে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বললে, নাহ্, টুনি মেমের পায়ের নখের কণাও এরা হতে পারে না।

আমার অভিমান হল। সাঁওতালি আমাদের প্রতিবেশী মেয়ে।

লক্ষ না করেই খান বলল, বুলেটে যে খুলি ফুটো করেছে, সে তো তুই বুঝিস, আমিও বুঝি, কিন্তু আদালত কি বুঝবে? তারা প্রমাণ চায়। উঁঃ, আদালত তো আদালত! অডিটের বেলা জান না কী হয়? পেনশন্ নেবার জন্য তুমি সার্টিফিকেট দাখিল করলে যে, তুমি এপ্রিল মাসে জীবিত আছ। অডিট শুধাল, কিন্তু মার্চ মাসের সার্টিফিকেট কই? আপনি যে মার্চ মাসে জীবিত ছিলেন, তার প্রমাণ কী? না হলে যে মার্চ মাসের পেনশনটা পাবেন না।

আমি বললুম, সেটা কিন্তু ঠিক। দিল্লির যাদুঘরে কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বিদেশি ভিজিটরকে ছোট্ট একটি শিশুর খুলি দেখিয়ে বললেন, ইটি শঙ্করাচার্যের খুলি। ভিজিটর অবাক হয়ে শুধাল, তার খুলি এত ছোট ছিল? মন্ত্রী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, এটা তার শিশু বয়সের খুলি। দুটো কিংবা ছটা খুলি যখন হতে পারে, তখন দু-টো কিংবা ছটা জীবন হবে না কেন? তা হলে একটা মার্চ মাসে গ্যাপ পড়াটাই-বা বিচিত্র কী?

ওসব কথা থাক; তার পর কী হল বল্।

তখন অনুসন্ধান করতে লাগলুম খুনটা হয়েছে ও’হারা সাহেব এই বাঙলোয় থাকাকালীন, না তার পরে কেউ খুন করে লোকটাকে নির্জন পোড়োবাড়িতে পুঁতে গেছে?

ও’হারা জেলে। দীর্ঘ মেয়াদে।

থানার পুরনো ফাইল কাগজপত্র ঘেঁটে যা আবিষ্কার করলুম, সে-ও বিচিত্র। সাহেব ছটা ইংরেজ পরিবারকে চকোলেটের ভিতর বিষ ঠেসে তাই খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল। প্রমাণের অভাব হয়নি। আব্ৰুগড় থেকে প্রায় ষাট মাইল দূরের এক ছোট্ট ডাকঘর থেকে ও’হারা পাঠিয়েছিল ছটি রেজেস্ট্রি পার্শেল ছ জন ইংরেজের নামে পোস্টমাস্টার সেই মর্মে সাক্ষী দিয়েছিল।

এদের দুজন থাকত অব্রুগড়ে, বাকিরা কাছেপিঠের চা-বাগানে। একইসঙ্গে একই জিনিস খেয়ে সবাই মরমর হয়েছিল বলে সিভিল সার্জন বুদ্ধি করে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে যে, চকোলেটের মধ্যে গড়বড় সড়বড় আছে। তাই তারা সে যাত্রা রক্ষা পায়। কেউ মরেনি।

কিন্তু ছ-টা কেন, একটা পরিবার একটা পরিবারই-বা কেন একজন লোককে খুন করার চেষ্টা করলেও দীর্ঘমেয়াদের জন্য শ্রীঘর। ও’হারা আলিপুরে।

ইতিমধ্যে বীরভূমের খোয়াইডাঙা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। খান বলল, এদের সঙ্গে আমাদের সবুজ সিলেটের কোনও মিল নেই বটে কিন্তু তবু এর রুক্ষ শুষ্ক একটা কঠোর সৌন্দর্য আছে। তার পর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলুম। মনে পড়েছে। হঠাৎ আমার মাথায় এক নতুন বুদ্ধির উদয় হল। ও’হারা যখন আইরিশম্যান তখন তার বন্দুক থাকাটা অসম্ভব নয়। খবর নিয়ে জানতে পারলুম, ছিল। আমি জানতুম কারও দীর্ঘমেয়াদের জেল হলে তার বন্দুক সরকারি তোষাখানায় জমা দেওয়া হয়। সেটা সেখানে পাওয়া গেল। বিশেষজ্ঞেরা বললেন, খুলির মাথায় যে বুলেট পাওয়া গেছে, সেটা নিঃসন্দেহে ওই বন্দুক থেকেই ছোঁড়া হয়েছে।

যাক। এতক্ষণে এক কদম এগোলুম কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, যে লোকটা খুন হয়েছে সে কে?

কলকাতায় যখন কলেজে পড়তুম তখন আমাদের হোস্টেলে রামানন্দ চাটুয্যে একবার জর্নালিজম সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে আসেন। মেলা কথা কওয়ার পর তিনি শেষ করেন এই বলে যে, যে কোনও জ্ঞান, যে কোনও খবর, তার মূল্য যত সামান্যই হোক না কেন, কোনও না কোনও দিন জর্নালিজমের কাজে সেটা লেগে যেতে পারে।

পুলিশের কাজেও দেখলুম তাই। সেই যে আমি অবসর সময়ে থানায় বসে পুরনো ফাইলের কাসুন্দি ঘাটতুম তাই লেগে গেল কাজে।

থানায় থানায় একখানা খাতাতে লেখা থাকে কে কবে নিরুদ্দেশ হল– অবশ্য যদি আত্মীয়স্বজন খবর দেয়। বিরাট দেশ ভারতবর্ষ– কত লোক কত রকমে কঞ্জুর হয়ে যায়, কে-বা রাখে তার খবর। তবু মনে পড়ল তিন বছর আগে এক বিহারি মজুর নিখোঁজ হয়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, কঙ্কালটা জড়ানো ছিল একটা চেক্ কম্বলে, এ ডিজাইনটা বিহারিদের ভিতর খুবই পপুলার।

যে পাড়াতে সে থাকত সেখানে জোর অনুসন্ধান চালালুম। অবশ্য ছদ্মবেশে। চায়ের দোকানে আশ-কথা পাশ-কথা কওয়ার পর একে একে তাকে শুধাই, সেই বিহারি রামভজনের কী হল?

যা খবর পাওয়া গেল সেটা আমাকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে দিল। তার নির্যাস–

রামভজনের বউ টুনি মেম—

আমি আশ্চর্য হয়ে বাধা দিয়ে বললুম, বিহারি মজুরের বউ মেম হয় কী করে?

খান বলল, সেই কথাই তো হচ্ছে। টুনি ও’হারা সাহেবের বাঙলোয় কাজ করত। পরে সায়েবের রক্ষিতা হয়ে যায়। তাই বিহারিরা তার নাম দেয় টুনি মেম।

রামভজন নাকি একদিন তার দেশের ভাই-বেরাদরকে বলে, সে দেশে চলে যাচ্ছে যা জমিয়েছে তাই দিয়ে খেত-খামার করবে। হয়তো তারও বাড়া আরেকটা কারণ ছিল। সামনাসামনি না হোক, আড়ালে-আবডালে অনেকেই টুনি মেমকে নিয়ে মস্করা-ফিস্কিরি করত। অতি অবশ্যই বোঝা যাচ্ছে রামভজনকে বাদ দিয়ে নয়।

এবং শেষ খবর, টুনি মেম আর তার স্বামীকে স্টেশনে নিয়ে যাবার সময় নাকি ওদের দু জনকে ও’হারার বাঙলোর গেটের সামনে দেখা যায়।

আমি শুধালুম, তার পর? কৌতূহল তখন আমার মাথায় রীতিমতো চাড়া দিয়ে উঠেছে।

আমাকে হতাশ করে খান বলল, ব্লাঙ্কো। মাস তিনেক পর যখন রামভজনের পরিচিত নতুন মজুররা আব্রুগড়ে এল–ওরা কিস্তিতে কিস্তিতে আসছে-যাচ্ছে হামেশাই- তখন তারা বলল, রামভজন আদপেই দেশে পৌঁছয়নি। আব্রুগড়ের কেউ বলল, টুনি মেমের বেহায়াপনায় তিতি-বিরক্ত হয়ে সন্ন্যাস নিয়েছে, কেউ বলল দার্জিলিং না কোথায় যেন চা-বাগানে কাজ নিয়েছে।

আর টুনি মেম?

সে তখন ও’হারার রক্ষিতা। কিন্তু রক্ষিতা বললে হয়তো ও’হারা ও টুনি মেম দুইজনারই প্রতি অবিচার করা হয়। ও’হারা টুনি মেমকে রেখেছিল রানির সম্মান দিয়ে আর টুনি মেম ও’হারাকে ভালোবেসেছিল লায়লী যে-রকম মজনূনকে ভালোবেসেছিলেন। কিন্তু এ-সব আমি পরে জানতে পেরেছিলুম।

আমি তখন মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটার একটা আবছা আবছা ছবি এঁকে ফেলেছি।

টুনি মেম স্বামীকে স্টেশনে নিয়ে যাবার পথে ও’হারার বাঙলোয় নিয়ে যায়। শীতকাল ছিল বলে রামভজন তার সেই চেক কম্বলখানা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। তার পর যে কোনও কারণেই হোক ও’হারা তাকে গুলি করে মেরে বাবুর্চিখানার ভিতের নিচে পুঁতে ফেলে। যে লোক ছটা পরিবারকে খুনের চেষ্টা করতে পারে তার পক্ষে এটা ধুলো-খেলা।

চায়ের দোকানে তদন্ত শেষ হলে পর একদিন থানা থেকে সরকারিরূপে চায়ের দোকানে যে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিফহাল ছিল তাকে ডেকে পাঠালুম। সে বলল কসম খেয়ে, কোনওকিছু তার পক্ষে বলা অসম্ভব তবে রামভজনের ওইরকম একখানা চেক কম্বল ছিল।

তা হলে মোদ্দা কথা দাঁড়াল এই, ও’হারা যদি রামভজনকে খুন করে থাকে তবে তার একমাত্র সাক্ষী টুনি মেম।

টুনি মেম কোথায়?

খবর পেলুম ও’হারার জেল হওয়ার পর টুনি মেম বড় দুরবস্থায় পড়ে। শেষটায় কোনও পথ না পেয়ে ও’হারা সায়েবের বাবুর্চির সঙ্গে উধাও হয়ে যায়।

এইবার সত্যি আমার সামনে যেন পাথরের পাঁচিল খাড়া হল। বহু অনুসন্ধান করেও কিছুমাত্র হদিস পেলুম না, খানসামা আর টুনি মেম গেল কোথায়।

তখন মনে মনে চিন্তা করলুম, সাহেবদের এই যে বাবুর্চি ক্লাসের লোক, এরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের বাড়িতে চাকরি পায় না। পুডিং-পাডিং রোস্টো-মোস্টো দুনিয়ার যত সব অখাদ্য এরা রাধে, শুয়ার গোরুর ঘাট এরা যেসব বানায় সেগুলো দূর থেকে দেখেই শেষবিচারের দিন স্মরণ করিয়ে দেয়– খায় কোন বঙ্গসন্তানের সাধ্যি! অতএব এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, ও’হারার বাবুর্চি নিশ্চয়ই অন্য কোনও সায়েবের চাকরি নিয়েছে।

তোকে পূর্বেই বলেছি, আব্রুগড়ের চতুর্দিকে মাইলের পর মাইলজুড়ে চা-বাগান আব-জাব করছে। আমি প্রতি উইক-এন্ডে আজ এটা কাল সেটায় তদন্ত করতে লাগলুম। পরনে খানসামা-বাবুর্চির পোশাক। সবাইকে শুধাই, বাবুর্চির চাকরি কোথাও খালি আছে কি না। আরও শুধাই, আমার এক ভাই নাম ভাঁড়িয়ে এক কুলি রমণীর সঙ্গে বসবাস করছে আসল কারণ অবশ্য আমি ও’হারার খানসামাটার নাম আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি– আমাদের মা তার জন্য বড় কান্নাকাটি করছে, তার খবর কেউ জানে কি না?

বাগানের পর বাগান ব্লাঙ্কো ড্র করেই যাচ্ছি আর আমার রোখও সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে।

শেষটায় আল্লার কুদরত, পয়গম্বরের মেহেরবানি, আর মুর্শিদের দোয়ার তেরস্পর্শ ঘটে গেল।

এক চা-বাগিচার কম্পাউন্ডার শুধু যে খবরটা দিল তাই নয়, বাঁকা হাসি হেসে বলল, ও! টুনি মেম। দেখে এসো গে তোমার বউদি কী সুখেই না আছেন।

আমি মেলা তর্কাতর্কি না করে ধাওয়া করলুম ম্যানেজার সায়েবের বাঙলোর দিকে। সেখানে গিয়ে শুনি, বাবুর্চি পরশু দিন থেকে উধাও, তার বউ কুলিলাইনের একটা কুঁড়েঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।

পড়ি পড়ি এই পড়ি, ত্রিভঙ্গ মুরারি-গোছ অতিশয় জরাজীর্ণ একখানা ছন-বাঁশের তৈরি কুঁড়েঘর। ঝপের তৈরি দরজাখানা পাশের মাটিতে পচছে।

ভিতরের দৃশ্য আরও মারাত্মক। সঁতসেঁতে নয়, রীতিমতো ভেজা মাটির ভিত। হেথায় গর্ত, হোথায় গর্ত। আল্লার মালুম গর্তে সাপ না ইঁদুর আছে। এক কোণে একটা ভাঙা উনুন। কবে যে তাতে শেষ রান্না হয়েছিল ছাই দেখে অনুমান করতে পারলুম না। তারই পাশে একটা সানকি গড়াগড়ি দিচ্ছে। দু-একটা ভাত শুকিয়ে কাঠ হয়ে তলানিতে গড়াচ্ছে। তারই পাশে মলমূত্র। নোংরা দুর্গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে।

দেয়ালে হেলান দিয়ে একটি হাডিড়সার বছর তিনেকের ছেলে চোখ বন্ধ করে ধুকছে। ছেলেটিকে কিন্তু তবুও যে কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছিল সেটা আমার চোখ এড়ায়নি। কেউ না বললেও আমি চট করে বলে দিতে পারতুম ইটি ও’হারার সন্তান। শুনেছি স্বর্গের দেবশিশুরা অমর, কিন্তু এই মরলোকে এসে যদি তাদের কাউকে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হত তবে বোধহয় তার চেহারা এরকমই দেখাত।

আমি যে গলাখাকরি দিয়ে ঘরে ঢুকলুম সে একবারের তরে চোখও খুলল না। সে শক্তিটুকুও তার গেছে।

অল্পক্ষণের জন্য নীরব থেকে খান বলল, বহু বছর পুলিশে কাজ করে করে আমি এখন সঙ্গ-দিল– পাষাণহৃদয়। তখন সবে পুলিশে ঢুকেছি– আমি ওদিক থেকে চোখ ফেরালুম।

সে আরও নিদারুণ দৃশ্য। একটা বছর দেড়েকের বাচ্চা তার মায়ের সায়া ধরে টানাটানি করছে। তারও সর্বাঙ্গে অনাহারের কঠিন ছাপ। ভালো করে কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না। আর সে কী বীভৎস গোঙরানো থেকে থেকে হঠাৎ অনাহারের দুর্বলতা যেন তার গলা চেপে ধরে আর কক্ করে গোঙরানো বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার নীরবতা আরও বীভৎস।

চ্যাটাইয়ের উপরে শুয়ে টুনি মেম। পরনে মাত্র একটি সায়া– শত-ছিন্ন, বুক ঢেকে একখানা গামছা জরাজীর্ণ। হাত দু-খানা বুকের উপর রেখে চোখ বন্ধ করে–কী জানি জীবন-মরণ-অনশন কিসের চিন্তা করছে।

স্পষ্ট দেখতে পেলুম, আসন্নপ্রসবা।

ক্ষণতরে পুলিশের কর্তব্য ভুলে গিয়ে আমার ভিতরকার মানুষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছিল। আমি সবলে তার কণ্ঠরোধ করে পুলিশের কর্তব্যে মন দিলুম। অর্থাৎ এ-রমণী যেন টের না পায় আমি পুলিশ। ও’হারার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে এসেছি।

তাই খানসামার ভাইয়ের পার্ট প্লে করে চিৎকার-চেঁচামেচি আরম্ভ করলুম, কোথায় গেল লক্ষ্মীছাড়াটা আপন বউকে ফেলে?

খান আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস মিতু, এত দুঃখের ভিতরেও মেয়েটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে ছিল। কারণটা বুঝতে পেরেছিস? জানিস তো, আমরা সিলেটিরা যদি কুলি-রমণী গ্রহণ করি তবে সে হয় রক্ষিতা, কিংবা লোকে বলে খানকি-নটীর বেলেল্লাপনা, কুলি-রমণীকে স্ত্রীর সম্মান সে-ও দেয় না, আর পাঁচজনের তো কথাই নেই। তাই এত দুঃখের ভিতরও বিবাহিত স্ত্রীর সম্মান পেয়ে তার চোখেমুখে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছিল।

আমি ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছি, কোথায় গেলেন আমার পরানের ভাই? আচ্ছা আমার খবর নিসনে, নিসনি, কিন্তু হতভাগার মা যে কেঁদে কেঁদে দেশটা ভাসিয়ে দিল তার পর্যন্ত তোয়াক্কা করল না! এদিকে আবার বউ-বাচ্চা পোষবার ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

আমার চেঁচামেচি শুনে কুঁড়েঘরের সামনে একপাল কুলি মেয়েম জমায়েত হয়ে গিয়েছে। আমি দোরে দাঁড়িয়ে বললুম, তোমাদের মধ্যে কেউ রাজি আছ, এদের জন্যে রান্নাবান্না করে দিতে, ঘর সাফসুতরো করতে, আর বেচারি বউটার সেবা-টেবা করতে? এখুনি তাকে পাঁচ টাকা দিচ্ছি। মাসের শেষে ফের পুরো মাইনে পাবে। আর এই আরও দু টাকা হাঁড়িকুড়ি চাল-ডালের জন্য।

সবাই চেঁচিয়ে বলল, মুন্নি, মুন্নি!

মুন্নি এগিয়ে এল। পুরনো ময়লা ছেঁড়া শাড়ি পরা। পরে জানতে পারলুম, এই গরিব বিধবা একমাত্র মুন্নিই যতখানি পারে টুনি মেমদের দেখভাল করেছে। সে-ও নিঃসম্বল, কীই-বা করতে পেরেছে! কিন্তু জানিস মিতু, দুর্দিনে দুটি দরদের কথাই বলে ক-টা লোক!

আর জানি, সেই মুনি আমাকে মৃদুকণ্ঠে কী বলল? বলল, আমাকে মাইনে দিতে হবে না সাহেব। ওদের জন্যে যা রান্না করব তার থেকে দু মুঠো আমাকে খেতে দিলেই হবে।

এর পরও যে খুদাতালায় বিশ্বাস করে না তাকে চড় মারতে ইচ্ছে করে।

মুন্নিকে বললুম, এই নাও আট আনা। তাড়াতাড়ি গিয়ে মুড়ি-মুড়কি যা পাও নিয়ে এসো।

চায়ের কথা বললুম না। ওই একটিমাত্র জিনিস চা-বাগানে ফ্রি। বিস্তর কুলি বিন দুধ-চিনি সুদ্ধমাত্র চায়ের লিকার খেয়ে খিদে মারে।

পাঁচজন সাধারণ মানুষের স্বভাব, কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে এসে সাহায্য না করার, কিন্তু তখন যদি এরই একজন বুকে হিম্মত বেঁধে সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন অনেকেই তার পিছনে এসে দাঁড়ায়।

একজন ইতিমধ্যে বসবার জন্য আমাকে একটা মোড়া এনে দিয়েছে। আমি বললুম, আমি একটা চারপাই কিনতে চাই। বেচবে?

চারপাই বলতে-না-বলতে এসে গেল। ভিজে ভিত থেকে উদ্ধার পেয়েও কিন্তু টনি মেমের মুখের ভাব বদলাল না।

তোকে বলেছি– হার্ড-বয়েল্ড পুলিশম্যান আমি তখনও হইনি, এমনকি অতিশয় সফ্ট-বয়েল্ডও না, তাই এই পুলিশের ভণ্ডামি করতে আমার বাধো বাধো।

আমি বাধা দিয়ে বললুম, এইবারে তুই আরম্ভ করলি সত্যি সত্যি মিথ্যে ভণ্ডামি। ভুলে গেছিস নাকি, স্কুলে আসবার সময় কাঁধে করে মা-হারা একটা কাঠবেড়ালিকে সঙ্গে নিয়ে আসতিস? মাস্টারমশাই সেটার জন্য চোটপাট করাতে গ স্কুল ছেড়ে নবাবি তালবের উপরে রাজার স্কুলে ট্রেনসফার নিলি?

খান যেন আদৌ শুনতে পায়নি। বলল, আসন্নপ্রসবা রমণী পুরুষের চিত্তহারিণী হয় না। কিন্তু তোকে কী বলব, মিতু, ওরকম সুন্দরী মেয়ে আমি জীবনে কখনও দেখিনি।

অনাদর, অবহেলা এবং সর্বোপরি অনাহার তাকে ম্লান করে দিয়েছে সত্য কিন্তু খাঁটি সোনার উপরকার ময়লা কতক্ষণ থাকবে! একে দু-দিন খেতে দিলে, দুটি মিষ্টি কথা বললে এ তো চোখের সামনে কদমগাছের মতো বেড়ে উঠবে, সর্বাঙ্গে সৌন্দর্যের ফুল ফোঁটাবে। এই তো এখুনি যখন মুড়ি এল আর ছেলেটি এই প্রথমবার প্রসন্ন নয়নে তার দিকে তাকাল, তখন তার মায়ের সৌন্দর্য যেন সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল।

গয়ার কালো পাথরে কোঁদা মূর্তিটি যেন টুনি মেম। হিন্দুদের যে সুন্দর সুন্দর কালো পাথরের মূর্তি আছে সেগুলো সুন্দর আমি জানি, কিন্তু কালো বলে আমার মন কখনও সাড়া দেয়নি। টুনি মেমকে দেখে বুঝলুম, মরা কালো পাথর জ্যান্ত টুনির রঙের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কী মারই না খেয়েছে!

আমি তো তেমন ফর্সা নই, আমিই মজেছিলুম টুনির রঙ দেখে। আর ও’হারা তো আইরিশম্যান। সে যে পাগল হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! গৌরী শ্রীরাধা কেন কৃষ্ণে লীন হয়েছিলেন, টুনি মেমকে দেখে বুঝতে পারলুম। তা সে যাক গে, তোকে আর কী বোঝাব? দেখাবার হলে দেখাতাম। ওই একটি মেয়ে এ-রঙ নিয়ে জন্মেছিল। তার আগেও না, পরেও না।

ইতিমধ্যে মুন্নি খিচুড়ি চড়িয়েছে। ঘরটা পরিষ্কার করা হয়েছে। একটা টেমি টিম টিম করে জ্বলছে। আমি কিছুক্ষণের জন্য বিদায় নিলুম।

বাগানের ছোটবাবু মুসলমান। তাঁকে সার্টিফিকেট দেখাবার ছল করে আমার পুলিশের পরিচয় দিলুম। খাওয়া-দাওয়া করলুম কিন্তু তাঁর বাবুর্চির সঙ্গে, পাছে কোনও সন্দেহের উদ্রেক হয়।

রাত নটার সময় টুনি মেমের ঘরে ফিরে দেখি মুন্নি তাকে আরও চারটি খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। আমাকে বলল, কদিন ধরে কিছুই জোটেনি, সাহেব; আজ হঠাৎ খাবেই-বা কী করে! তবু বলছি, পেটের বাচ্চার জন্য দুটি খেতে।

টুনির পরনে শাড়ি। সেদিকে তাকাতে মুন্নি বলল, আট আনা পয়সা দিয়ে মুদির দোকান থেকে ছাড়িয়ে এনেছি।

আমি বললুম, খুব ভালো করেছ।

মুন্নি আপন কথাখানা নিয়ে এসেছে। সেটা চেটাইয়ের উপর পেতে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

আমি মোড়াটা চারপাইয়ের পাশে এনে বসলুম। টুনি সেই আগের মতো শুয়ে আছে। হাত দু-খানা বুকের উপর।

আমি উঠি উঠি করছি, এমন সময় টুনি চোখ বন্ধ রেখেই কোনওপ্রকারের ভূমিকা না নিয়ে বলল, আপনি সবকিছু জানতে চান না?

আমি হকচকিয়ে উঠলাম। কিন্তু তার পরের কথাতেই আশ্বস্ত হলুম। বলল, কী করে এ অবস্থায় পৌঁছলুম!

খান বলল, উত্তেজনা-ঔৎসুক্যে আমি তখন অর্ধমৃত। না, না, না, তোমার এখন শরীর দুর্বল, তুমি ওই ধরনের কিছু একটা বলা-না-বলার মতো কী যেন একটা অর্ধপ্রকাশ করেছিলুম।

টুনি বলল, আমি আপনাদের ভাষায় কুলি। আপনারা আমাদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না, অথচ জানেন, আমি একদিন রাজরানির সম্মান পেয়েছিলুম।

খান বলল, বিশ্বাস করবি নে মিতু, ঠিক এইরকম ধরনের মার্জিত ভাষায় কথা বলেছিল। আমি তো অবাক।

আমি বললুম, আম্মো।

খান বলল, সেটা পরে পরিষ্কার হল। তোকে সব বলছি, টুনি মেম যা বলেছিল।

বলল, অনেক অপমান নির্যাতন সয়েছি। হেন অপমান নেই যা আমায় সইতে হয়নি মুখ বুজে। নতুন অপমান আর কী হতে পারে? তাই মনে হচ্ছে আমার যাবার সময় বুঝি ঘনিয়ে এল।।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে পড়েছে। মুন্নির নাক অল্প অল্প ডাকছে। টিমেটা বাতাসে এদিক-ওদিক নাচছে।

টুনি বলল, ও’হারা সায়েবের বোন এসেছিল বিলেত থেকে এ দেশের হাতি-গণ্ডার দেখবে বলে। তারই আয়া হয়ে আমি ও-বাড়িতে ঢুকি। মেম চলে যাওয়ার পরও তিনি আমায় ছাড়লেন না।

আপনি মুরুব্বি, আপনাকে সব কথা বলতে আমার বাধছে। তবু যে বলছি, তার কারণ আপনি এসেছেন আমার ত্রাণকর্তা, আমার বন্ধুরূপে। আপনাকে না বলব তো বলব কাকে? আর এ যেন আমার বুকের উপর বোঝা হয়ে চেপে বসে আছে। এ-বোঝা না নামিয়ে তো আমার নিষ্কৃতি নেই। আপনি শুনুন।।

আমাদের প্রণয় হয়েছিল। আমি স্বীকার করছি, স্বামী বর্তমান থাকতে পরপুরুষের দিকে তাকানোই পাপ, প্রণয় সে তো মহাপাপ। তার জন্য যে সাজা পরমাত্মা আমায় দেবেন তার জন্য আমি তৈরি।

কিন্তু ভাবো দিকিনি ভাই সায়েব, আমি কুলি-কামিন। আমি কালো, কিন্তু প্রতিবেশিনীরা বলত, আমার সর্বাঙ্গ নাকি চুম্বক, পুরুষকে টানে। টানত নিশ্চয়ই বিশেষ করে ছোঁড়ারা যখন হ্যাংলার মতো আমার দিকে তাকাত তখনই সেটা বুঝতে পারতুম। কিন্তু ওরা কী চায়, সেটা আমি আরও ভালো করেই বুঝতে পারতুম। আমাকে রক্ষিতা করে রাখবার সাহসও এদের ছিল না। যাক, এসব কথা আর খুলে বলার প্রয়োজন নেই।

তখন যদি কেউ আমাকে রানির সম্মান দেয় তখন সে প্রলোভন জয় করা কি সহজ পরীক্ষা? সায়েব আমাকে প্রথম দিন থেকেই ইংরেজি পড়াতে শুরু করল, বলল, তোমাকে আমি আমার মনের মতো করে গড়ে তুলব। ভালোবাসলে মানুষ কী না করতে পারে। কিংবা হয়তো পূর্বজন্মে আমি কোনও পাঠশালা-মক্তবের আঙ্গিনা ঝাঁট দিয়ে সেবা করেছিলাম বলে এ জন্মে তারই পুণ্যের ফলে আমার লেখা-পড়া যে গতিতে এগিয়ে চলল সেটা দেখে স্বয়ং সায়েবই অবাক।

এতক্ষণ পরে টুনি মেম আমার চোখের দিকে তাকাল। বোধহয় দেখে নিল এসব সূক্ষ্ম জিনিস বোঝবার স্পর্শকাতরতা আমার কতখানি আছে। আফটার অল, সে তো আমাকে জানে খানসামার ভাই খানসামা হিসেবে!

আমার চোখে কী দেখল কে জানে। আজও আমার কাছে রহস্য। কিন্তু বলে যেতে লাগল ঠিক সেইভাবেই।

বলল, বিদ্যাবুদ্ধি কতখানি হয়েছিল বলতে পারিনে, কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা কুলি-মজুররা যে ভালোবাসি, একে অন্যের প্রতি আমাদের যে টান হয়, সেটাকে আমি নিন্দা করছিনে, কিন্তু সায়েবের পাশে বসে প্রেমের ভালো ভালো গান আর কবিতা পড়ে পড়ে আমি এক নতুনভাবে তাকে ভালোবাসতে লাগলুম, আর সে যে আমাকে কত দিক দিয়ে কতখানি ভালোবাসে সেটাও দিনের পর দিন আমার কাছে পরিষ্কার হতে লাগল।

টুনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল তাকে থামাই। কিন্তু সে তখন আপন মনে যেন কথা বলছে। আবার কখনও-বা সংবিতে ফিরে চোখ-দুটি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে আপন কথা বলে যায়।

সায়েবের মতো এ রকম মানুষ আমি আর দেখিনি। সামান্য কয়েক ঘণ্টা দিনে কাজ করত চা-গাছের সার নিয়ে, আর তার জন্য পেত কাড়ি কাড়ি টাকা। আর খরচ করত বেহুশের মতো। আমি কিছু বললে হেসে উত্তর দিত, যত খুশি যে যখন কামাতে পারে তখন যত খুশি খরচ করবে না কেন?

এই তো আমার স্বামীকে দশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল

খান বলল, আমি তখন উত্তেজনার চরমে। এইবারে জানতে পারব, সেই টাকা নিয়ে টুনি মেমের স্বামী দেশে ফিরে গিয়ে খেতখামারের প্ল্যান করছিল কি না? সে টাকা পেয়েছিল কি? না ও’হারা ডবল ক্রসিং করেছিল! রামভজন গুলি খেল কী করে, কেন, কার হাতে? কিন্তু হঠাৎ কেন জানি নে, টুনি মেম কথার মোড় ফিরিয়ে নিল। আমি শুধু লক্ষ করলুম, টুনির মুখ কেমন যেন ঈষৎ বিকৃত হয়ে গেল। পাছে সে সন্দেহ করে বসে, আমি কী মতলব নিয়ে এসেছি, তাই আমিও এই ব্যাপারটার ওপর চাপ দিলুম না। মনকে সান্তনা দিলুম, এতখানি যখন বলেছে, পরে মোকা পেলে বাকিটুকু পাম্প করে নেব।

কারণ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, টুনি মেম তো সাধারণ কুলি-কামিন নয়ই, সে অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সে ভীষণ শক্ত মেয়ে। খুদাদা (বিধিদত্ত) চরিত্রবল তার নিশ্চয়ই ছিল, তার ওপর এত বেশি তুফান-ঝড়, এত বেশি বিচিত্র ভাগ্যবিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে মার খেয়ে খেয়ে আজ এই স্যাঁতসেঁতে কুঁড়েঘরে এসে পৌঁছেছে যে, এখন সে নির্ভয়– তার আর যাবে কী, তার আর হারাবার মতো কী আছে যে সে তারই ভয়ে আপন গোপন কথা ফাঁস করবে? সে যদি নিজের থেকে কিছু না বলে তবে আমার চতুর্দশ পুরুষের সাধ্য নেই যে, আঁকশি দিয়ে তার পেটের কথা বার করি। এই একফোঁটা দুবলাপাতলা মেয়ে, পুলিশের এক ফুয়ে সে কঁহা কঁহা মুলুকে উড়ে যাবে, কিন্তু আমি এ তত্ত্বটাও জানি যে সে ভাঙবে না, তার দার্চ অবিশ্বাস্য।

টুনি মেম বলল, কিন্তু সায়েব ছিল পাগল। আমি ভেবে-চিন্তেই বলছি, সায়েব ছিল পাগল। দুটো জিনিসে যে তার পাগলামি কত বিকট রূপ ধারণ করতে পারত সে যারা দেখেছে তারাই বলতে পারবে।

তারই স্মরণে টুনি মেম যেন আঁতকে উঠল। বলল, বেশ ভালোমানুষের মতো দিব্যি দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, আমাকে আদর-সোহাগ করার অন্ত নেই, সারা সকালটা হয়তো কাটাল ক্যাটালগ দেখে দেখে বিলেত থেকে আমার জন্য কী সব আনাবে বলে, তার পর হঠাৎ আরম্ভ হয়ে গেল একটানা মদ খাওয়া। চলল দিনের পর দিন। কাজকর্ম তো বন্ধ বটেই, নাওয়া-খাওয়ারও খোঁজ নেই।

একটুখানি সুস্থাবস্থায় পেয়ে যদি বললুম, দুটি মুখে দাও, তবে সে কাতর স্বরে হয় বলত, নেশা কেটে যাবে, নয় বলত, মুখ দিয়ে কিছুই নামবে না! ঘুম আর মদ, মদ আর ঘুম। আমার জাতভাইরা এদেশে এসে মদ খেতে শেখে। তাদের কেউ কেউ খায়ও প্রচুর। ও জিনিস আমার সম্পূর্ণ অজানা নয়, কিন্তু ওরকম বেহদ মদ কাউকে আমি খেতে দেখিনি, শুনিনি। সে তখন মানুষ নয়, পশুও নয়, যেন কিছুই নয়।

আমি তার পা জড়িয়ে ধরে বলেছি কতবার তুমি যদি ওই মদটা না খেতে তবে আমি নির্ভয়ে বলতে পারতুম, আমার মতো সুখী পৃথিবীতে কেউ নেই। সুস্থ অবস্থায় থাকলে সে-ও আমার পা জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করত, আর কখনও খাবে না। কী লজ্জা! যাকে আমি মাথার মণি করে রেখেছি সে দেবে হাত আমার পায়ে! অবশ্য এ কথাও ঠিক, আস্তে আস্তে তার এই মদের বান কমতির দিকে চলল। আমার আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু আমার কপালে এত সুখ সইবে কেন?

খান দম নিয়ে বলল, দেখ মিতু, এর পর বহুকাল চা অঞ্চলে কাজ করার ফলে বিস্তর সায়েবকে প্রচুর কালো মেয়ে নিতে দেখেছি এবং ছেড়ে যেতেও দেখেছি, কাচ্চা-বাচ্চা থাকলে তাদের মিশনারির কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা আমাকেও মাঝে মাঝে করতে হয়েছে এসব ওদের ডালভাত। কিন্তু টুনি মেম স্বতন্ত্র।

আমি বললুম, সে আর তোকে বলতে হবে না। তার পর কী হল, তাই বল। বোলপুর আর বেশি দূর নয়।

খান বলল, টুনির কাহিনীও শেষ হতে চলল। শোন্। টুনি বলল, আমার দ্বিতীয় দুঃখ ছিল, সায়েবের অসম্ভব রাগ। ওই মদেরই মতো। বেশ দিন কাটছে, হাসিখুশির মানুষ সায়েব। হঠাৎ কোনও আরদালি বা বেয়ারা একটা কিছু বলল, আর সায়েব রেগে পাগলের মতো তাকে বন্দুক হাতে নিয়ে করল তাড়া। আমি কতবার যে ছুটে গিয়ে তার পায়ে জড়িয়ে ধরে তাকে ঠেকিয়েছি তার হিসাব নেই। তবু বুঝতুম, যদি মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় এ-রকম ধারা করত। তা নয়। সম্পূর্ণ সুস্থাবস্থায়। আমার নিজের কোনও ভয় ছিল না, কারণ আমার ওপর সে একবার মাত্র রেগে গিয়ে পরে এমনই লজ্জা পেয়েছিল যে, আমার মনে আর কোনও সন্দেহ ছিল না যে সে আর আমার ওপর রাগবে না। কিন্তু চাকরবাকরকে নিয়ে হত মুশকিল। আমার স্বামীকে

খান থামল। আমি তেড়ে বললুম, ওই রাগের মাথায় খুন করেছিল না কি?

খান বলল, ভাই এবারেও আমাকে প্রলোভন সংবরণ করতে হল। ঠিক যখন আমার মনে হল, এবারে টুনি আসল কথায় আসবে ঠিক তখন সে আবার তার কথার মোড় ঘোরালো। আমি নাচার। আবার মনকে সান্ত্বনা দিলুম, এই নিয়ে দু-বার হল; তিনবারের বার নিশ্চয়ই বলবে। কিন্তু টুনি পাড়ল অন্য কথা। বলল, ওই রাগই আমার সর্বনাশ করল। তার পর আমাকে শুধাল আমি এদেশে অনেক দিন ধরে আছি কি না? আমি বললুম, না, ভাইয়ের সন্ধানে হালে এসেছি। তখন টুনি বলল, তা হলে জানতে, যা সবাই জানে। ওই নিয়ে মোকদ্দমা হয়েছিল।

সায়েব ক্লাবে বড় একটা যেত না। একদিন ফিরে এল চিৎকার করতে করতে বদ্ধ মাতালের মতো, অথচ মদ খায়নি। পাগলের মতো শুধু চেঁচাচ্ছে, আমাকে অপমান, এত বড় সাহস! আমাকে অপমান, এত বড় সাহস। আমি দেখাচ্ছি, আমি কী করতে পারি? আমি কাউকে ছাড়ব না। আমি দেখাচ্ছি, আমি কী করতে পারি। আমি চেষ্টা করেছিলুম সায়েবকে ঠাণ্ডা করতে কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারলুম না। টাকা নিয়ে মোটরে করে ফের বেরিয়ে গেল।

ত্রিসংসারে আমার কেউ নেই। তাই নিয়ে আমি কখনও দুঃখ করিনি। আমার সায়েবকে পেয়েই আমি খুশি ছিলুম, আমি সুখী ছিলুম, কিন্তু রাত যখন ঘনিয়ে এল আর সায়েব ফিরল না তখন যে আমি কী করি, কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলুম না। এর পূর্বে সায়েব আমাকে কখনও একা ফেলে যায়নি। একা থাকতে আমার ভয় করে না। কিন্তু সে রাত্রে কেমন যেন এক অজানা ভয় এসে আমাকে অসাড় করে দিল। সে রাত্রিটা আমার কী করে কেটেছিল আজ আর বলতে পারব না।

পর দিন সায়েব সন্ধের দিকে ফিরে এল। আমি তাকে হাতে ধরে নিয়ে যেতে চাইলুম বাথরুমের দিকে। সে কিন্তু আমাকে দু হাতে শূন্যে তুলে নিয়ে বসাল উঁচু একটা চেয়ারের উপর। নিচে আমার পায়ের কাছে ছোট্ট একটি মোড়ার উপর বসে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে আমার দিকে। সায়েব এভাবে প্রায়ই আমাকে বসাত, আর একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার বড় লজ্জা করত। আমি কে, আমি কী?

ভাই সায়েব, তুমি কিছু মনে কর না, আমাকে সব কথা বলতে দাও।

ঠিক তার চারদিন পর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল।

কুকুর-বেড়ালকেও মানুষ এরকম লাথি মেরে বাড়ি থেকে খেদায় না। আমি সায়েবের রক্ষিতা, আমার তো কোনও হক্ক নেই। পুলিশ বাড়ি তালাবন্ধ করে সিলমোহর মেরে চলে গেল। আমি একবস্ত্রে বাঙলোর বারান্দা থেকে বাগানের বকুলতলায় এসে বসে রইলুম। সেখানে সায়েব আমার জন্য একটা সিমেন্টের বেদি বানিয়েছিল।

যে চাকর-নফর সেদিন সকালবেলা পর্যন্ত আমার পা চেটেছে, তারাই এখন আমাকে লাথিঝাটা মারল। চাকরি গেছে যাক কিন্তু ওই কুলি মেমটাকে যতখানি পারি অত্যাচার-অপমান করে তার দাদ তুলে নিয়ে যাই।

আমি একটি কথাও বলিনি।

মোকদ্দমাতে সব কথা বেরুল। সবাই জানে। সেই যেদিন সায়েব ক্লাবে গিয়েছিল সেদিন ক্লাবের কয়েকজন মুরুব্বি তাকে নাকি আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলে, অনেক চা-বাগিচার ইংরেজ ছোকরা দিশি মেয়ে রাখে কিন্তু আমার সায়েব আমাকে নিয়ে খোলাখুলি যে মাতামাতি করছে সেটা ইংরেজসমাজের পক্ষে বড়ই কেলেঙ্কারির ব্যাপার।

আমি জানতুম, আমার সায়েব এ-সব চা-বাগিচার সায়েবদের ঘেন্না করত। কতবার তাকে বলতে শুনেছি, যেসব নেটিভদের উপর সায়েবরা ডাণ্ডা মেরে বেড়ায়, তারা শিক্ষাদীক্ষার কোনও সুযোগই পায়নি, তাই তারা আজ মজুর, আর ওই সায়েবরা আপন দেশে সব সুযোগ পেয়েও নিতান্ত অপদার্থ হতভাগা বলে কিছুই করে উঠতে পারেনি। আপন দেশে মজুরের কাজ করতে হলে যেটুকু ধাতুর প্রয়োজন সেটুকুও এসব লক্ষ্মীছাড়াদের নেই বলে তারা এদেশে এসে নেটিভদের উপর দাবড়ে বেড়ায়।

তোমাকে বলেছি, ভাইয়া, আমার সায়েব অপমানিত বোধ করলে রেগে একেবারে পাগলের মতো হয়ে যেত। সে নাকি তখন যে কটা সায়েবকে হাতের কাছে পেয়েছে তাদের গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়েছে আর চিৎকার করে একই কথা বার বার বলেছে, আমি তোমাদের মতো ভণ্ড ছোটলোক নই। আমি যাকে নিয়েছি তাকে আমি আমার স্ত্রীর সম্মান দিয়েই রেখেছি। এখানে বলে রাখি, ভাই সায়েব, এরা সবাই জানত কথাটা সত্যি। আব্রুগড়ের পাদ্রি সায়েব আমাদের বিয়ের মন্ত্র পড়তে নারাজ জেনে সায়েব ঠিক করেছিল, কলকাতায় আমাদের বিয়ে হবে।

খান অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, তিনবারের বারও ঘোড়া জল খেল না। কারণ আমি তখন থাকতে না পেরে টুনিকে শুধালুম, তার স্বামী সম্বন্ধে যখন কোনও খবর নেই তখন তাদের বিয়ে হত কী করে? অবশ্য আমি ভাবখানা করেছিলুম যেন ওটা অমনি একটা কথার কথা, যেন নিছক একাডেমিক প্রশ্ন। আজও বুঝতে পারিনি টুনি মেম আমাকে সন্দেহ করেছিল কি না। টুনি শুধু বলল, সায়েব নাকি তাকে বলেছিল, সে কলকাতার উকিলদের কাছ থেকে তাদের সম্মতি আনিয়েছে, তবে সেটা নাকি খুব পরিষ্কার নয়। চুলোয় যাক গে সে-সব কথা, আমার ইচ্ছে শুধু জানবার তার স্বামীর নিখোঁজ হওয়া সম্বন্ধে সে কী জানে কিন্তু সেই যে ও’হারার বদমেজাজির কথা বলার সময় সে তার স্বামীর কথার আভাস দিয়েছিল, এবারে সেটুকুও না।

আমি বললুম, ওই কথাটুকু আমিও তো জানতে চাই।

খান বলল, টুনি জল খেয়ে নিয়ে খেই তুলে বলল, সায়েবকে ক্লাববাড়ি থেকে জোর করে বের করে দেওয়া হয়। সেদিন বাড়ি ফিরে সায়েব আমাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছিল– সে তো বলেছি তার পর মোকদ্দমায় বেরুল সায়েব পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরের একটা ছোট্ট পোস্টআপিসে গিয়ে যে ছ জন সায়েব তার গায়ে হাত তুলেছিল তাদের নামে ছ প্যাকেট বিষ-মাখানো চকলেট বিজ্ঞাপন হিসেবে পাঠায়। আচ্ছা, বল তো ভাইয়া, আমি যে বলেছিলুম সায়েবের মাথায় ছিট ছিল সেটা কি ভুল বলেছি? এটা কি ধরা পড়ত না?

পাঁচটি পরিবারের লোক যদি একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ে আর সায়েবলোগের ব্যাপার সঙ্গে সঙ্গে সিভিল সার্জনকে ডাকা হয় তবে কি তার মূল ধরা পড়বে না? পার্সেলের উপর যে পোস্টআপিস থেকে সেগুলো এসেছিল তার খেই ধরে পুলিশ দু দিনের ভিতর ধরে ফেলল যে সে-ই পার্সেলগুলো পাঠিয়েছিল। পোস্টমাস্টার আদালতে তাকে শনাক্ত করল।

খান মন্তব্য করে বলল, টুনি মেমের নরম আর শক্ত দুটো দিকই দেখতে পেলুম তার পরের কথাতে। বলল, মানুষ মারা পাপ, আর ভাবো দিকিনি ওইসব পরিবারের ছোট্ট ছোট্ট কাচ্চাবাচ্চাগুলো। আবার পাঠিয়েছিল একটি ছোট ডাকঘর থেকে। ধরা পড়তে কতক্ষণ। কিন্তু একথাও তোমাকে বলছি, ভাইয়া, আমি ঘুণাক্ষরেও সায়েবের এই দুর্বুদ্ধির কথা অনুমান করতে পারলে তার সামনে গলায় দড়ি দিতুম।

আদালতে সায়েব একটি কথাও বলেনি।

শুধু শহরময় ছড়িয়ে পড়ল, সায়েব নাকি হাজতে যাবার সময় তার উকিলকে বলেছিল, সে তার স্ত্রীর ন্যায্য সম্মান রাখবার চেষ্টা করেছে মাত্র। একথা শুনে শহরের লোক কী বলেছিল জানিনে, কিন্তু ওই আমি আমার শেষ সম্মান পেলুম।

সেই সম্মানের উঁচু আসন থেকে আরম্ভ হল আমার পতন।

আমি তখন যাই কোথায়? দেশের-দশের চোখে আমি সায়েবের রক্ষিতা। রক্ষিতাকে রক্ষা করনেওলা যখন আর কেউ নেই তখন সে যাবে কোথায়? যাবার জায়গা নয়, মরার জায়গা একটা আছে। বেশ্যাপাড়া। কিংবা মরতে পারি ফাঁস দিয়ে। কিন্তু

টুনি মেম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু তখন সায়েবের বাচ্চা আমার পেটে। তার প্রাণ নিই কী করে?

খান বলল, এর পর টুনি মেম কী করে ধাপের পর ধাপ নামতে নামতে সেই জাহান্নামের রদ্দি কুঁড়েঘরে এসে পৌঁছল তার বর্ণনা দেয়নি। তুই সেটা যে রকম খুশি কল্পনা করে নিতে পারিস।

আমি বললুম, আমি স্যাডিস্ট নই। আমি বীভৎস রসে আনন্দ পাইনে। তার পর কী হল তুই বলে যা।

খান বলল, টুনি সে রাত্রে আর কিছু বলেনি। তার ক্লান্তি দেখে আমিও আর খোঁচাখুঁচি করিনি।

ওদিকে আমার বসের সঙ্গে কথা ছিল, টুনিকে আবিষ্কার করতে পারলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেলিগ্রাম করে জানাই। অতি অনিচ্ছায় পরের দিন তাঁকে কোড টেলিগ্রাম করে জানালুম। গেলুম স্টেশনে তাকে রিসিভ করতে।

সন্ধ্যাবেলা তিনি নামলেন পুলিশের ইউনিফর্ম পরে। আমি অবাক হয়ে বললুম, স্যার, করেছেন কী? টুনি বড় শক্ত মেয়ে। পুলিশকে সে একটি কথাও বলবে না। এমনকি আপনি চাকর-নফরের বেশ পরলেও ধরে ফেলতে পারে।

খেলুম উৎকট ধমক। বললেন, রেখে দাও ওসব জ্যাঠামো। এই ঘোষাল-বান্দা ঘড়েল ঘড়েল খুনিদের পেটের নাড়ির কিমি বের করেছে একশো সাতান্ন বার, আর আজ তুমি এলে শোনাতে, কী করে একফোঁটা ঘুড়ির ঠোঁটের কথা বের করতে হয়। চল, তোমাকে হাতেকলমে দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি তাকে বহুৎ বোঝাবার চেষ্টা করলুম। খেলুম গণ্ডা তিনেক ধাতানি। কীই-বা করি আমি? তিনি উঁদে অফিসার। পাঠান আসামিকে তিনি খুন কবুল করাতে পেরেছেন বলে তার খুশ-নাম ছিল– পাঠানকে বেঈমান বলে অপমান করলে রেগেমেগে সব-কিছু ফাঁস করে দেয়, এই অজানিত প্যাঁচটি জানতেন বলে। আমি চুপ করে গেলুম।

গট গট করে মিলিটারি বুটে পাড়া সচকিত করে তিনি ঢুকলেন টুনি মেমের কুঁড়েঘরে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তার পর, মশাই, আরম্ভ হল পুঁদে পুলিশের যত রকম কায়দা-কেতা ফন্দি-ফিকির সন্ধি-সুড়ুক তার নির্মম প্রয়োগ। দুনিয়ার ভয়-প্রলোভন, মৃদু ইঙ্গিত, কটু সম্ভাষণ সব-কুচ চালালেন ঘড়েল পুলিশ-কর্তা।

কিন্তু সেই যে পুলিশ দেখে টুনি মেম মুখ বন্ধ করেছিল, সে মুখ আর সে খুলল না। ঝাড়া ছ-টি ঘণ্টা পুলিশ সাহেব তার শেষ চেষ্টা দিয়ে ঘেমে নেয়ে বেরুলেন সেই কুঁড়েঘর থেকে ভোরের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে। টুনি মেম একটা হা-না পর্যন্ত বলেনি।

আমার লজ্জাটুকু পর্যন্ত পুলিশ-কর্তা রাখলেন না। আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলুম তিনি যেন প্রকাশ না করেন যে, আমার কাছ থেকে সবকিছু জানতে পেরে তিনি তার সন্ধান পেয়েছেন। আমি যে খানসামার ভাই সেই খানসামার ভাই-ই থেকে যাই। কিন্তু টুনি মেমের নীরবতার পাঁচিলে মাথা ঠুকে ঠুকে পুলিশ-কর্তা ঘায়েল হয়ে গিয়ে সে কথাটাও প্রকাশ করে দিলেন। এমনকি তিনি আমাকে ভিতরে ডেকে পাঠালেন। যেতে হল– বস যে।

টুনি একবার আমার দিকে এক লহমার তরে তাকিয়েছিল।

কী বলব, মিতুয়া, সে দৃষ্টিতে ঘৃণা তাচ্ছিল্য কী ছিল, কিছুই বলতে পারব না। শুধু মনে হয়েছিল রহস্যময় সে দৃষ্টি।

খান বলল, তার পরদিন প্রসবের সময় টুনি মেম এই দুঃখের সংসার ত্যাগ করল।

এটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। আমি অবাক হয়ে বললুম, সে কী!

হুঁ।

আমি শুধালুম, তা হলে ওই যে লোকটা খুন হয়েছিল তার কোনও হিল্যে হল না?

খান অনেকক্ষণ কোনও উত্তরই দিল না। শেষটায় বলল, সে যাক গে। এর পরও আমি বহু রহস্যের সমাধান করতে পারিনি– সে নিয়ে আমার শোক নেই। আমি শুধু এখনও টুনি মেমের শেষ চাউনির কথা ভাবি। সে চাউনিতে কী ছিল?

দুর্দশার চরমে বাচ্চাদুটো যখন ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে তখন আমি এসে তাদের চোখের জল মুছে দিলুম, টুনি তখন নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তাকে তার সর্ব দেহমন নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছিল– তিনি যে তার ডুবুডুবু ভাঙা নৌকোখানিকে পাড়ে এনে ভিড়ালেন। আমাকে সে দেখেছিল তারই দূতরূপে, তাঁরই ফিরিশতারূপে। তার পর হঠাৎ দেখে, আমি দেবদূত নই, আমি শয়তান। তার দুর্দিনে যেসব চাকর-বাকর তাকে লাঞ্ছিত-অপমানিত করেছিল আমি তাদের চেয়েও অধম। আমার মতলব ছিল তার বাচ্চাদুটোকে খাইয়ে-দাইয়ে তাকে খুশি করে, তার জীবনের চরমধন তার স্বামীকে ঝোলাবার জন্য প্রমাণ সংগ্রহ করা।

এর পর আর কোনও কথা হয়নি। গাড়ি বোলপুরে এসে থামল।

চেল্লাচেল্লিতে ম্যানেজার গোসাঁই স্বয়ং এসে খানকে ডবল খানা দিল। গাড়ি যখন চলতে আরম্ভ করেছে তখন আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল টুনি মেমের বাচ্চাদুটোর কথা। চেঁচিয়ে খানকে শুধালুম, ওদের কী হল? খান শুনতে পেল না। হাসিমুখে শুধু হাত নাড়ল।

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments