Tuesday, May 13, 2025
Homeভৌতিক গল্পভুতুড়ে বেড়াল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভুতুড়ে বেড়াল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

ভুতুড়ে বেড়াল – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

আমার ভাগ্নে ডন যেমন বিছু তেমনি খেয়ালি ছেলে। তার কীর্তিকলাপ নিয়ে এ যাবৎ অনেক গল্প বলেছি। কিন্তু এবার যে গল্পটা বলছি, সেটা ভারি অদ্ভুত আর রহস্যময়। এ যাবৎ আমি নিজেই এই ঘটনার মাথামুকিছু বুঝতে পারিনি। একটা ব্যাখ্যা অবশ্য করেছিলাম। কিন্তু সেটা নেহাত মনগড়া।

আষাঢ় মাস। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কয়েক পশলা বৃষ্টির পর বিকেলে মেঘ কেটে আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। কিন্তু আমাদের এই মফস্বল শহরের রাস্তার অবস্থা হয়ে গেছে শোচনীয়। খানাখন্দে জল জমেছে। তোবড়ানো পিচের সঙ্গে কাদা আর পাথরকুচি এমন মিলেমিশে গেছে যে পা ফেললেই আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা। তার ওপর নানারকম যানবাহনের উৎপাত তো আছেই। আচমকা রাস্তার নোংরা জল পিচকিরির মতো ছিটকে এসে জামাকাপড় বিচ্ছিরি করে ফেলবে।

এ অবস্থায় রোজকার মতো বেড়াতে বেরুনোর ইচ্ছে চেপে রাখতেই হল। বরং তার চেয়ে চুপচাপ বসে গোয়েন্দা উপন্যাস পড়াই ভালো। র‍্যাক থেকে তাই কাঠমাণ্ডুতে কাটামুণ্ডু নামে একখানা বই টেনে নিলুম।

সবে বইটার পাতা খুলেছি, হঠাৎ পিঠের দিকে জোরালো চিমটি খেয়ে উঃ। করে উঠলুম। তারপর খাপ্পা হয়ে ঘুরে দেখি শ্রীমান ডন নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রেগেমেগে বললুম,-থাপ্পড় খাবি বলে দিচ্ছি কিন্তু। তোকে বলেছি না, কিছু বলার থাকলে সামনে এসে বলবি। এমনি করে পেছন থেকে কক্ষনও চিমটি কাটবি নে।

ডন আমার হুমকি গ্রাহ্য করল না। তেমনি নির্বিকার মুখে বলল, রথের মেলা দেখতে যাব!

–যাবি তো যা। আমাকে চিমটি কাটছিস কেন?

–তুমি আমাকে নিয়ে যাবে।

–কালই তো নিয়ে গিয়েছিলুম। রোজ-রোজ মেলায় গিয়ে নতুন আর কী দেখবি?

একটা বেড়াল কিনববলে ডন আমার হাতের বইটা চেপে ধরল।

বুঝলুম এবার কাঠমাণ্ডুতে কাটামুণ্ডুর আর রক্ষে নেই। তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বললুম, কালই তো তোকে একটা রথ আর একটা বাঘ কিনে দিয়েছি। ছ্যা-ছ্যা! বাঘের পাশে বেড়াল রাখবি তুই?

ডন হাসল না। বই থেকে হাত সরাল না। নির্বিকার মুখে বলল,–ভোঁদা বলল বেড়াল বাঘের মাসি। মাসিকে না দেখতে পেলে বাঘ রেগে যাবে। মামা! তুমি শিগগির ওঠো। দেরি করলে কী হবে জানো তো?

বইটা আরও জোরে সে আঁকড়ে ধরল। অগত্যা আমাকে উঠে পড়তে হল। বললুম, ঠিক আছে। চল, যাচ্ছি। এবার লক্ষ্মীছেলের মতো বই থেকে হাত সরিয়ে নে।

বেড়ালটার দাম দশ টাকা, মামা! মা দিয়েছে তিন টাকা। দিদি দিয়েছে দু টাকা।

–হুঁ। আমাকে বাকি পাঁচ টাকা দিতে হবে। কিন্তু দশ টাকা দাম, কে বলল তোকে?

–আমি এক্ষুনি রথের মেলা থেকে আসছি?

–বলিস কী রে? এই জলকাদায় তুই গেলি কী করে? তোর জুতোয় তো একটুও কাদা দেখছি নে!

–ভোঁদাদের আমবাগান দিয়ে বুড়োশিবের মন্দিরতলা দিয়ে—তারপর–

–বুঝেছি, বুঝেছি! এবার বইটা ছাড়!

–আগে তুমি পাঁচটা টাকা দাও।

টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা পাঁচ টাকার নোট ওর হাতে দিলুম। তখন ডন বই থেকে হাত সরিয়ে নিল। তারপর হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল, তুমি কিন্তু আমার সঙ্গে যাবে মামা!

–কেন? যেমন একা গিয়েছিলি তেমনি একা চলে যা। বেড়াল কিনে নিয়ে আয়।

ডন চোখ বড় করে বলল,–মেলা থেকে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে না? বুড়োশিবের মন্দিরের কাছে জটাবাবা থাকে। তারপর জানো তো মামা? ভোঁদাদের আমবাগানে কন্ধকাটা থাকে। কন্ধকাটা বাগান পাহারা দেয়। নইলে সব আম চুরি হয়ে যেত। ভোঁদা বলছিল। আর জানো মামা?

কথা বাড়াতে না দিয়ে বললুম, চল, বেরুনো যাক।

আসলে এমন সুন্দর রোদ্দুরে ঝলমল করা বিকেলটা ঘরে বসে বই পড়ার চেয়ে বাইরে কাটানোর সুযোগ ডনই তো এনে দিয়েছে। তা সে চিমটি কেটেই হোক বা পাঁচটা টাকা নিয়েই হোক। তাই শেষপর্যন্ত ডনের প্রতি খুশি হয়েছিলুম।

বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরুলে একটা ঘাসে ঢাকা পোড়ো-জমি। তারপর ভোঁদাদের সেই আমবাগান। বাগানের পাশ দিয়ে পায়ে-চলা পথটায় একটু-আধটু জলকাদা আছে। তবে কিনারার ঘন ঘাসে পা ফেলে সাবধানে হাঁটলে জলকাদা এড়ানো যায়। ডনের বুদ্ধির প্রশংসা করা উচিত। এভাবে একটু ঘুরপথে গেলে মেলার দূরত্ব অবশ্য বেড়ে যায়। তা যাক। বৃষ্টিধোয়া সবুজ গাছপালা, পাখির ডাক, রংবেরঙের প্রজাপতির খুশি-খুশি নাচানাচি দেখতে-দেখতে রথের মেলায় যাওয়ার চেয়ে কাঠমাণ্ডুতে কাটামুণ্ডু বেজায় বিচ্ছিরি ব্যাপার!

বুড়োশিবের মন্দিরের দিকটায় জলকাদার বালাই নেই। বাঁধানো চত্বরের পর খেলার মাঠ। সেই মাঠের একধারে মেলা বসেছে। ভিজে ছপছপে ঘাসের ওপর প্রতিদিনের মতো ছেলেরা ফুটবল খেলছে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলুম। ডন তাড়া দিয়ে বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে মামা। এখন কি খেলা দেখার সময়?

বললুম,–নারে! যদি ওদের বলটা এসে গায়ে পড়ে? প্যান্টশার্ট নোংরা হয়ে যাবে যে!

ভ্যাট! তুমি কিছু জানো না! এবার আমরা ঝিলের ধারে ওই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাব। –ডন আমার হাত ধরে টানল। উৎসাহে হাঁটতে-হাঁটতে সে বলল, রামুবোপা ঝিলের জলে কাপড় কাঁচে জানো তো মামা?

–জানি বইকী।

–রামু আর তার গাধাটা হেঁটে-হেঁটে কেমন সুন্দর রাস্তা করেছে দেখবে চলো।

–তুই সেই রাস্তায় গিয়েছিলি বুঝি?

–হ্যাঁ। নইলে আমাকে মাঠে দেখতে পেলেই ভোঁদা জোর করে গোলকিপার করত যে!

ঝোঁপজঙ্গলের ভেতর ঢুকে লক্ষ করলুম, রামু ধোপা বিকেলে এই চমৎকার রোদ্দটা পেয়ে কাঁচা কাপড়গুলো শুকিয়ে নিচ্ছে। তার গাধাটা ঝিলের ধারে মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে।

যাই হোক, জলকাদা বাঁচিয়ে অবশেষে মেলার ভিড়ে পৌঁছলুম। ডন আমাকে একটা দোকানের সামনে নিয়ে গেল। দোকানটা আসলে তেরপল ঢাকা ছোট্ট একটা তাঁবু। ভেতরে নানারকম জন্তুর পুতুল। না–পুতুল বলা হয়তো ঠিক হচ্ছে না। কারণ খুদে জন্তুগুলো দেখতে অবিকল আসল জন্তুর মতো। খরগোশ, কাঠবেড়ালি, কয়েকরকম পাখি, গিরগিটি, ফণাতোলা সাপ, ব্যাঙ, কুকুরছানা এইসব। সেগুলোর মধ্যে একটা কালো বেড়াল জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। দেখার মতো গোঁফও আছে। একেবারে আসল বেড়ালের সাইজ।

মাথার সন্ন্যাসীদের মতো চুড়ো করে বাঁধা চুল, মুখে একরাশ গোঁফ-দাড়ি, তেমনি কুচকুচে কালো একটা লোক এই দোকানের মালিক। ডনকে দেখেই সে হাসল,–তাহলে বেড়ালটা দেখছি তোমার খুব পছন্দ হয়েছে খোকাবাবু! কিন্তু দশ টাকার কমে বেচব না।

ডন বুকপকেট থেকে টাকাগুলো বের করে তাকে দিতে যাচ্ছিল। আমি বললুম, কই, আগে বেড়ালটা দেখি।

সন্ন্যাসী চেহারার দোকানদার বলল,–খোকাবাবু আপনাকে সঙ্গে এনেছে বুঝি? ভালো। আমি কাকেও ঠকাইনে বাবু! এ বেড়াল যেমন-তেমন বেড়াল নয়। জ্যান্ত বললেও ভুল হয় না।

বলে সে কালো বেড়ালটা আমাকে দিল। সত্যি বলতে কী, ওটা হাতে নেওয়ামাত্র মনে হল, যেন আসল জ্যান্ত বেড়াল। তেমনি নরম তুলতুলে শরীর। লেজটাও নড়ছে। চমৎকার বানিয়েছে তো!

ততক্ষণে ডন দশটা টাকা দোকানদারকে দিয়ে ফেলেছে। একটু দরাদরি করার সুযোগ পেলুম না। দোকানদার একগাল হেসে টাকাগুলো কপালে ঠেকিয়ে ফতুয়ার ভেতর ভরল। তারপর বলল, মাত্র দশ টাকায় বেচে লোকসানই হল বাবু! কিন্তু কী আর করা যাবে? কালো বেড়াল অলক্ষুণে বলে কেউ কিনতে চায় না। এই খোকাবাবুর যেমন চোখ আছে, তেমনি সাহসও আছে বটে। তাই দশ টাকায় বেচতে চেয়েছিলুম। তবে খোকাবাবুকে বলছি, আপনাকেও বলছি, বেড়ালটা একটু চোখে চোখে রাখবেন।

জিগ্যেস করলুম,–কেন বলো তো?

দোকানদার চাপাগলায় বলল,-মম্ভরপড়া বেড়াল। রাতবিরেতে হঠাৎ জ্যান্ত হয়। বুঝলেন তো?

ওর কথা শুনে হেসে ফেললুম। বলল কী হে! নকল বেড়াল জ্যান্ত হয়। তোমার মন্তরের এত জোর?

সে চোখ টিপে বলল, হাসবেন না বাবু! খোকাবাবুকে বলবেন, যেন সাবধানে রাখে।

ডন আমার হাত থেকে বেড়ালটা কেড়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল পথে যেতে যেতে বললুম,–ডন! লোকটা তোকে রামঠকানো ঠকিয়েছে জানিস? আমার মনে হল, ভেঁড়া তোয়ালেতে কালো রং মাখিয়ে ভেতরে স্পঞ্জ ঠেসে বেড়ালটা তৈরি করেছে। গোঁফ আর চোখদুটো প্লাস্টিকের না হয়ে যায় না। মুখে একটু লালচে রং মাখিয়ে দিয়েছে। ব্যস!

ডন আমার কথায় কান দিল না। হঠাৎ আমাকে ফেলে দৌড়তে শুরু করল। ওর পিছনে আমাকে দৌডুতে দেখলে লোকেরা কী ভেবে হয়তো হইচই বাধাবে। তাই ধীরেসুস্থে হাঁটছিলুম।…

বাড়ি ফিরে দেখি, ডন বেড়ালটাকে দুধ খাওয়াবে বলে রান্নাঘরের দরজায় প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। বললুম, কী রে? তুই ওটাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য অমন দৌড়ে চলে এলি? বোকা ছেলে! নকল বেড়াল কি দুধ খেতে পারে?

দিদি রেগে গেল আমার ওপর। তুই যত নষ্টের গোড়া! তোর পাশ্লায় পড়ে ও গোল্লায় যেতে বসেছে। না পড়াশুনো, না কিছু। যা বায়না ধরবে, তা মেটানোনা চাই-ই। যেমন গুণধর মামা, তেমনি গুণধর ভাগ্নে।

বললুম, যা বাবা! আমি কী করলুম?

–করলুম মানে? বেড়াল কেনার কথা তুই-ই ওর মাথায় ঢুকিয়েছিস।

বেগতিক দেখে বললুম,–ঠিক আছে। তা দাও না একটুখানি দুধ। পাথরের গণেশ যদি দুধ খেতে পারে

দিদি অমনি কপালে হাত ঠেকিয়ে নমো করে বলল,–এই সন্ধ্যাবেলা দেব দেবতার নামে যা-তা বলবি নে বলে দিচ্ছি। আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছিলুম জানিস?

তারপরই বিষ্টু ছেলের চিমটি খেয়ে উঃ! করে উঠল এবং করুণ মুখে বলল, লক্ষ্মী সোনা! অমন করে না। ছাড়! ছাড়! উঁহু! দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি।

ডনের দিদি আমার ভাগ্নি পিঙ্কি তার পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, মাথায় দুটো চটি লাগাতে পারছ না মা? যখনই পড়তে বসব, তখনই বাঁদরের বাঁদরামি শুরু হবে।

ডন মাকে ছেড়ে দিয়ে ফিক করে হেসে বলল, বাঁদর না দিদি, বেড়াল! যেমন-তেমন বেড়াল নয়, সাধুবাবার মন্তরপড়া বেড়াল।

পিঙ্কি চোখ পাকিয়ে বলল, দাঁড়া! বাবাকে আসতে দে। তারপর দেখাচ্ছি মজা!

ডন বেড়ালটা তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করতেই সে চোখের পলকে ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল। পিঙ্কি বেড়ালকে বড্ড ভয় পায়।

দিদি রান্নাঘর থেকে একটা ছোট্ট বাটিতে একটুখানি দুধ নিয়ে বেরুল। বলল, এই নে। তোর বেড়ালকে দুধ খেতে দিয়ে মামার কাছে পড়তে বোস। তোর বাবা বাড়ি ফিরে যদি দেখেন, এখনও তুই পড়তে বসিসনি, তাহলে তোর বেড়ালের অবস্থা কী হবে ঝতে পারছিস?

ডন লক্ষ্মীছেলের মতো এক হাতে সেই কালো বেড়াল আর অন্য হাতে দুধের বাটি নিয়ে সোজা আমার ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর বলল,–মামা! আলো জ্বেলে দাও।

সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলুম। ডন বেড়ালটাকে মেঝের কোণে বসিয়ে তার মুখের কাছে দুধের বাটিটা রাখল। বললুম, ঠিক আছে। বেড়ালটার খিদে পেলে দুধ খেয়ে নেবে। আয়! তুই পড়তে বোস।

ডন আমার বিছানায় বসে পড়াশুনো করে। আমি চেয়ার টেনে তার কাছাকাছি বসে তাকে পড়াই। আজ সে এমনভাবে বসল যেন বেড়ালটাকে সে দেখতে পায়। আমাকেও চেয়ারটা একটু সরাতে হল।

বুঝতে পারছিলুম, ডনের মন বেড়ালটার দিকে পড়ে আছে। কিন্তু আমার অবস্থাও তা-ই। যতবার ঘুরে বেড়ালটার দিকে তাকাচ্ছি, কেন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। দোকানদারটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কালো রঙের অবিকল জ্যান্ত চেহারার বেড়ালটার উজ্জ্বল চোখদুটো হিংস্রভাবে যেন আমাকেই দেখছে। মনে হচ্ছে, এখনই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর।

কিছুক্ষণ পরে ডন বলল, দুধ খেল নাকি দেখে আসি মামা!

বললুম, খিদে পেলেই খাবে। তুই ও নিয়ে ভাবিসনে।

–না মামা! এতক্ষণে ওর খিদে পেয়েছে। মা একটুখানি দুধ দিল যে! ওইটুকু দুধে কি ওর পেট ভরে?

একটু ঝুঁকে দুধের বাটি দেখে নিয়ে বললুম, নারে! এখনও খায়নি। বরং এক কাজ করা যাক। ওর মুখটা দুধের বাটিতে গুঁজে দিই। তাহলে লোভের চোটে দুধটুকু খেয়ে ফেলবে।

ডন একটু ভেবে নিয়ে বলল, উঁহু! তুমি কিছু জানো না মামা! বেড়াল জিভ দিয়ে চেটে দুধ খায়। ভোঁদার পিসিমার হুলোকে দুধ খেতে দেখিনি বুঝি?

ঠিক এই সময় আচমকা লোডশেডিং হয়ে গেল। ডন ব্যস্তভাবে বলল, মামা! শিগগির নোম জ্বালো!

টেবিলের ড্রয়ার থেকে মোমবাতি খুঁজে বের করলুম। তারপর দেশলাই জ্বেলে মোমবাতিটা সবে ধরিয়েছি, ডন একলাফে বিছানা থেকে মেঝেয় নেমে চেঁচিয়ে উঠল, মামা! মামা! আমার বেড়াল কই?

মোমবাতির আবছা আলোতে কালো বেড়ালটা দেখতে পেলুম না। দুধের বাটি যেমনকার তেমনি রাখা আছে। ঝটপট বিছানায় বালিশের পাশে রাখা টর্চ বের করে সুইচ টিপলুম। একপলকের জন্য চোখে পড়ল, এইমাত্র একটা কালো বেড়ালের লেজ দরজার বাইরে অন্ধকারে মিশে গেল।

ততক্ষণে ডন চ্যাঁচিমেচি জুড়ে দিয়েছে। দিদি লণ্ঠনহাতে রান্নাঘরের বারান্দা থেকে জিগ্যেস করছে, কী হল? কী হল? চ্যাঁচিচ্ছিস কেন?

আমি টর্চ জ্বেলে বারান্দায় গেলুম। তারপর দেখতে পেলুম বেড়ালটাকে। বারান্দায় একটা থামের কাছে বসে আছে। চোখদুটো টর্চের আলোয় আরও হিংস্র দেখাচ্ছে। থমকে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে থাকলুম।

ডন কিন্তু একটুও ভয় পেল না। ছুটে গিয়ে বেড়ালটাকে তুলে নিয়ে এল। তারপর তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, বুঝলে মামা? ওইটুকু দুধ দেখে রাগ হয়েছে। তাই রাগ করে পালিয়ে যাচ্ছিল।

সে ঘরে ঢুকে দুধের বাটিটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। বেড়ালটা তো জ্যান্ত বেড়াল নয় যে অমন করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে! এ তো একটা অসম্ভব ব্যাপার। অথচ আমি তার লেজের ডগা দেখেছি দরজার বাইরে।

নাকি আমার চোখের ভুল?

ঠিক আছে। কিন্তু বেড়ালটাকে বাইরে নিয়ে গেল কে? লোডশেডিংয়ের সুযোগে এ কাজ কেউ করতেই পারে। কিন্তু কে করবে? পিঙ্কি কালো বেড়ালকে ভীষণ ভয় পায়। দিদি ওদিকে রান্নাঘরে লণ্ঠন জ্বালতে ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া দুরন্ত ছেলে ডনের বেড়াল নিয়ে তার মজা করার সাহসই নেই। ছেলের প্রতি দিদির অবশ্য মায়া মমতা বেশি। তাই তাকে প্রশ্রয় দেয়। ডনের বাবা খুব রাশভারী মানুষ। এখন তিনি অফিসার্স ক্লাবে আড্ডা দিচ্ছেন। বাড়ি ফিরতে রাত নটা বেজে যাবে। বাড়ির কাজের লোক মন্টু ছুটি নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে গেছে। কাজেই বাইরের কেউ কক্ষনও বেড়ালটাকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যায়নি।

সন্ন্যাসী চেহারার দোকানদার বলেছিল,–মন্তরপড়া বেড়াল। চোখে-চোখে রাখবেন। রাতবিরেতে হঠাৎ জ্যান্ত হয়।

ভ্যাট! ওসব গাঁজাখুরি কথা।

কিন্তু ধাঁধাটা থেকে গেল। সেইসঙ্গে অস্বস্তিও বেড়ে গেল।…

রাত্তিরে ডন শোয় পিঙ্কির কাছে। কিন্তু পিঙ্কি সে-রাতে ডনকে কিছুতেই কালো বেড়াল নিয়ে শুতে দেবে না। অগত্যা দিদি ছেলেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমার ঘরে শুতে পাঠিয়েছিল। ডন আমার পাশে শুয়ে চাপাগলায় বলল, মা আমার বিড়ালের জন্য অনেকটা দুধ দিয়েছে, মামা! দেখবে, আর ও পালাবে না। রাত্তিরে ওর আরও খিদে পাবে তো? পেট ভরে গেলে তখন ঘুমিয়ে পড়বে। আচ্ছা মামা! ওর একটা সুন্দর নাম বলো না?

বললুম, কালু রাখতে পারিস। কিংবা কালুয়া। নাকি কাল্লু রাখবি?

–ভ্যাট! ওসব বিচ্ছিরি নাম। একটা ইংরিজি নাম বলো তো মামা?

–ব্ল্যাকি।

–না, না। সুন্দর নাম বলো!

–এখন কিছু মাথায় আসছে না। কাল রাখবখন। ঘুমিয়ে পড়।

ডন একটু ঘুমকাতুরে ছেলে। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু অস্বস্তিতে আমার ঘুম আসছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, বেড়ালটা যদি আবার কিছু করে বসে? যদি চুপি-চুপি মশারির ভেতরের ঢুকে আমার গলায় কামড় বসায়? ডনের দিকে যেন ওর দৃষ্টি নেই। ব্যাটাচ্ছেলের শুধু আমার দিকে চোখ। আর কী হিংস্র ওর চাউনি।

টর্চটা মাথার পাশে রেখে দিয়েছিলুম। একটু শব্দ শুনলেই টর্চ জ্বালব। তারপর যদি সত্যি ওই হতচ্ছাড়া বেড়ালটা কোনও কাণ্ড বাধায়, ওকে লাঠিপেটা করব। আগেভাগে তাই মন্টুর লাঠিটা এনে এ ঘরে বিছানার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছিলুম।

তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি। সেই ঘুম হঠাৎ কেন ভেঙে গেল জানি না। রাস্তার দিকের জানালা বন্ধ ছিল। শুধু বাড়ির ভেতরের দিকের একটা জানলা খোলা ছিল। ভেতরের বারান্দায় সারারাত একটা চল্লিশ ওয়াটের বালব জ্বলে। মশারির ভেতর থেকে সেই আলোটা আবছা দেখা যায়। কিন্তু ঘুম ভেঙে দেখি ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ফ্যানের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তার মানে লোডশেডিং। তারপর কানে এল বৃষ্টির শব্দ। বুঝতে পারলুম, ভ্যাপসা গরমের জন্যই ঘুম ভেঙেছে। তারপরই মনে পড়ে গেল বেড়ালটার কথা। অমনি মশারির একটা পাশ একটুখানি তুলে টর্চ জ্বাললুম। কিন্তু কী আশ্চর্য! বেড়ালটাকে দেখতে পেলুম না। অস্বীকার করছি না, সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠেছিল। এদিকের দুধের বাটিটা তেমনি রাখা আছে।

মাথা বের করে টর্চের আলো ফেলে দেখলুম, বাটিতে একটুও দুধ নেই। দেখামাত্র আতঙ্কে টর্চের সুইচ থেকে আঙুল সরে গেল। আবার ঘন অন্ধকারে ঘর ভরে গেল। বৃষ্টিটা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। মশারির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলুম। মন্টুর লাঠিটা কী কাজে লাগাব ভেবেই পেলুম বা।

কতক্ষণ নিঃসাড় অবস্থায় শুয়ে থাকার পর হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠে বসলুম। ডনের ঘুম ভাঙানো যাবে না। তাছাড়া ওকে জাগিয়েই বা কী হবে? যদি বা ওকে জাগানো যায়, বেড়াল নেই শুনেই ও চ্যাঁচিমেচি শুরু করবে।

সাবধানে মশারি থেকে বেরিয়ে টর্চ জ্বেলে মন্টুর লাঠিটা নিলুম। তারপর ঘরের ভেতরে চেয়ার-টেবিল-খাট এবং বইয়ের র‍্যাকের তলায় আলো ফেলে বেড়ালটা খুঁজে দেখলুম। কোথাও বেড়ালটা লুকিয়ে নেই। তাহলে কি ভুতুড়ে কালো বেড়ালটা রাতদুপুরে সত্যি জ্যান্ত হয়ে দুধ সাবাড় করে পালিয়ে গিয়েছে?

দরজা খুলে বেরুতে সাহস হচ্ছিল না। খোলা জানালাটার কাছে গিয়ে বাইরে টর্চের আলো ফেললুম। বৃষ্টিটা এবার জোরালো হয়েছে। বৃষ্টির ছাটে বারান্দা ভিজে গিয়েছে। জ্যান্ত বেড়াল জলকে বেজায় ভয় পায়। কিন্তু এই বেড়ালটা তো ভূতুড়ে। কাজেই তার কথা আলাদা। এতক্ষণে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিল। তারপর শুরু হল মেঘের গর্জন। তার কিছু করার নেই। টর্চের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। যদি আচমকা ভুতুড়ে কালো বেড়ালটা পেছন থেকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে?

কথাটা ভাবামাত্র সব সাহস উবে গেল। ঝটপট মশারির ভেতর ঢুকে পড়লুম। লাঠিটা এবার বিছানায় আমার পাশেই রেখে দিলুম। আতঙ্কে আর ঘুম আসতে চাইছিল না। বৃষ্টির জন্য ভ্যাপসা গরমটা অবশ্য আর ছিল না।…

দিদির ডাকাডাকিতে চোখ খুলে দেখি, ভোর হয়ে গেছে। ডন তখনও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সাড়া দিয়ে বললুম, কী হয়েছে?

জানালার ওধার থেকে দিদি খাপ্পা মেজাজে বলল,–এসব তোরই কীর্তি। ডনের মাথায় যত দুষ্ট বুদ্ধি তুই-ই যোগাচ্ছিস।

মশারি থেকে বেরিয়ে বললুম,–আহা, হয়েছেটা কী বলবে তো?

দিদি বলল, পিঙ্কি কালো বেড়ালকে ভয় পায়। তাই তোরা মামা-ভাগ্নে মিলে রাত্তিরে কখন খেলনা-বেড়ালটাকে পিঙ্কির ঘরের দরজার সামনে রেখে এসেছিস। দরজা খুলেই পিঙ্কি ভয় পেয়ে কেঁদে-কেটে অস্থির।

বলে দিদি বাঁ-হাতে সেই কালো বেড়ালটা জানালা গলিয়ে ভেতরে ছুঁড়ে দিল। তারপর গজগজ করতে করতে চলে গেল।

অবাক হয়ে দেখলুম, সেই বেড়ালটাই বটে। টেবিলের পায়ার কাছে চার ঠ্যাং তুলে আছড়ে পড়েছে। দিদি ওটাকে রাগের চোটে এত জোরে ছুঁড়েছে যে বেচারার পেট ফেঁসে গিয়েছে এবং ভেতরে ঠাসা কয়েক টুকরো স্পঞ্জ বেরিয়ে পড়েছে।

দিনের বেলায় আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ডন জেগে ওঠার আগেই কালো বেড়ালটাকে তুলে নিয়ে ফাটা জায়গায় স্পঞ্জের টুকরোগুলো ঠেসে ঠিকঠাক করে দিলুম। লক্ষ করলুম পেটটা কালো সুতো দিয়ে সেলাই করা ছিল। সেই সুতো টেনে কোনওরকমে গিট দিয়ে রাখলুম। তারপর বেড়ালটাকে দুধের বাটির কাছে আগের মতো বসিয়ে দিলুম।

কিন্তু প্রশ্ন হল, বেড়ালটা এ ঘর থেকে পিঙ্কির ঘরের দরজার সামনে গেল কী করে? আর বাটির দুধই বা কে খেল?

মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলুম না। একটু পরে ডনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বললুম,–তোর বেড়াল খিদের চোটে সবটুকু দুধ সাবাড় করেছে।

ডন ধড়মড় করে উঠে মশারি থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আহ্লাদে আটখানা হয়ে বেড়ালটাকে খুব আদর করতে থাকল। বলল, মামা! আজই কিন্তু একটা ভালো ইংরেজি নাম চাই। নইলে কী হবে বুঝতে পারছ তো?

আনমনে বললুম,–ডিকশনারি খুঁজে ভালো একটা নাম দেব। তুই ভাবিসনে।

সেদিন ছিল সোমবার। আমি গেলুম অফিসে। ডন গেল স্কুলে। বেড়ালটা আমার ঘরে রেখে গিয়েছিল ডন। বাটিতে যথারীতি দুবও রেখেছিল সে। অফিস থেকে আমার ফিরতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখি, ডন প্রচণ্ড হই চই বাধিয়েছে। দিদি ছেলেকে সামলাতে পারছে না। ব্যাপার কী?

পিঙ্কি আমাকে দেখে হাসতে হাসতে বলল,–জানো মামা কী হয়েছে? একটু আগে ভোঁদার পিসিমা এসেছিলেন। ডনের বেড়ালটা নাকি কখন ওঁদের বাড়ি গিয়ে ওঁর হুলোর সঙ্গে ভাব জমাতে চেয়েছিল। আর হুলো অমনি ডনের বেড়ালটাকে কামড়ে ধরে আছাড় মেরেছে। তারপর নখের আঁচড়ে ফালাফালা করে ফেলেছে। ওই দেখো না মামা! উঠোনে পড়ে আছে।

উঠোনের কোণে কালো একটা ন্যাতার মতো জিনিস দেখতে পেলুম। শুধু মুন্ডুটা ঠিকঠাক আছে এইমাত্র।

ডনকে কিছু বলার আগে ঘরে ঢুকে দুধের বাটিটা দেখতে গেলুম। আশ্চর্য ব্যাপার, বাটিতে একফোঁটা দুধ নেই। বাটিটা অবশ্য কাত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু মেঝেতে দুধের কোনও চিহ্ন নেই।

হঠাৎ মনে হল, ভোঁদার পিসিমার হুলো বেড়ালটাই কি কাল সন্ধ্যায় এ ঘরে এসে দুধ সাবাড় করার পর ডনের বেড়ালটাকে বারান্দায় রেখে গিয়েছিল? হুলোই কি আজ দিনের বেলায় আবার এসে

নাহ। ভোঁদাদের বাড়ি এ বাড়ি থেকে দুটো বাড়ির পরে। হুলোর গায়ে এত জোর নেই যে একটা খেলনার বেড়াল অতদূরে বয়ে নিয়ে যাবে। তাছাড়া হুলো এ বাড়িতে এসে উৎপাত করত বলে মন্টু একটা ফাঁদ পেতেছিল এবং সেই ফঁদে হুলোর লেজের ডগা আটকে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত লেজের ডগাটুকু ফেলে হুলো প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে এ বাড়িতে আর তাকে দেখা যায় না।

কাজেই রহস্যটা থেকেই যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরে ডনের তাগিদে কালো বেড়ালের সেই ঘেঁড়াখোঁড়া মড়াটা নিয়ে আবার রথের মেলায় যেতে হল। কিন্তু সন্ন্যাসী চেহারার সেই দোকানদার তার দোকান গুটিয়ে চলে গেছে। রাগ করে ডন কালো বেড়ালের মড়াটা ঝিলের জলে ছুঁড়ে ফেলে বলল,-মন্টুটা আসুক! তারপর হুলোকে ফঁদে আটকে মুণ্ডু কেটে বলি দেব।

ওকে আশ্বাস দিয়ে বললুম,–হ্যাঁ। হুলোটাই তোর বেড়ালটাকে মেরে ফেলেছে।

কথাটা বললুম বটে, তবে ধন্দটা মনে থেকে গেল। আজও থেকে গিয়েছে।…

GolpaKotha
GolpaKothahttps://www.golpakotha.com
Golpo Kotha - Read bengali all time favourite literature free forever in golpakotha.com গল্প কথা - আপনি যদি গল্পপ্রেমী হন তাহলে এই ওয়েবসাইটটি অবশ্যই আপনার জন্য
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments